ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আম পাড়ার সরকারি ক্যালেন্ডার এবং বাস্তবতা

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ২১ মে ২০২৩

আমের নাম শোনেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। একটিও আমগাছ নেই সেসব দেশের বাজারেও আম কিনতে পাওয়া যায়। কারণ বিশ্বব্যাপী সুস্বাদু আমের চাহিদা রয়েছে এবং এজন্য আমকে ফলের রাজা বলা হয়। রাজাকে মানুষ চিনবে না জানবে না এমন সেটা কেমন কথা? মৌসুমি ফল আম গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জন্মে। সাধারণত শীত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমের মুকুল বের হয় এবং তারপর তিন থেকে চার মাসের মধ্যে আম পেকে যায়। তবে আজকাল কৃষিতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে সারা বছর আম উৎপাদন শুরু হয়েছে। সেসব আমের গুণগত মান ও স্বাদ মৌসুমি আমের মতো হয় না।

আমাদের দেশে কাঁঠাল জাতীয় ফল হলেও আম প্রধান ফল। প্রতি বছর আমের মৌসুম ঘিরে আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে সরকারকে নানা নীতি-পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়। আমের ভোক্তাদের জন্য সেসব নীতি গণমাধ্যমে আগেভাগে বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয়। এর মধ্যে আমের উৎপাদন বাড়ানো, যত্নসহকারে বাগানের পরিচর্যা, গাছে সময়মতো স্প্রে করা, হার্ভেস্টিং, ফল সংরক্ষণ, ভেজালমুক্তভাবে বাজারজাতকরণ, বিদেশে রপ্তানিকরণ ইত্যাদি।

ভালো জাত ও মানের আমের উৎপাদনের সাথে আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের ভালো দাম ও বেশি মুনাফা জড়িত থাকায় আজকাল আম নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় অনেক কৃষক শস্যদানা আবাদ বাদ দিয়ে ফসলি জমিতে মৌসুমি ও বারোমাসি আম চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

ওয়েজ আর্নারের যুগে পদার্পণ করেও কৃষিকে অদ্যাবধি আমাদের জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। কিন্তু কৃষিজমির বেশিরভাগ মালিক শহরে বসবাস করে। বর্তমানে যাদের ৫-১০ বিঘা পৈতৃক কৃষিজমি আছে ও সঙ্গে একটি চাকরি বা সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা যে কোনো প্রয়োজন বা উছিলা দেখিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে বসতি গাড়েন।

এই শ্রেণির মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা, মর্যাদা ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশায় তাদের সব কৃষিজমি ও ভিটেবাড়ি হাতছাড়া করতে চান না। এজন্য আমাদের দেশে প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষীদের সংখ্যা বেশি। শস্যদানার জমি প্রান্তিক কৃষকদের হাতে সহজে প্রদান করা হলেও আমের বাগানগুলো শহুরে মালিকরা বছরের শুরুতে আগেভাগেই ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে দেন।

এ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমাদের দেশে বর্তমানে আমবাগানের মালিকরা শহরে বসবাস করেন এবং তাদের নিযুক্ত পছন্দনীয় গরিব প্রান্তিক চাষীদের কাছে চুক্তিভিত্তিতে সেসব জমি ও বাগান ইজারা দিয়ে থাকেন। এছাড়া মৌসুমি ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা ভিন্ন জেলা থেকে এসে আমের মুকুল বের হওয়ার আগেই বাগানগুলো চুক্তিভিত্তিক ইজারা নিয়ে আমের ব্যবসা পরিচালনা করেন।

খুব কম আমবাগান মালিক আছেন যারা গ্রামে থেকে নিজেরাই আমচাষ করেন। তাই যারা আম চাষ করে ও দিনরাত কষ্ট করে বাগান পাহারা দিয়ে থাকে প্রকৃতপক্ষে আমের লাভ তাদের হাতে যায় না। আমচাষী ও প্রকৃত আমের বাগানের মালিক ভিন্ন ভিন্ন জন। কার্যত এভাবে আমের উৎপাদন ও বিপণনের লাভ মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে চলে যায়।

অপুষ্ট আম আগেভাগে পেড়ে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বাজারজাতকরণ চলে। এসব আম পাকিয়ে ফরমালিন মেখে সংরক্ষণের মাধ্যমে অসময়ে দীর্ঘদিন বাজারে বিক্রি করা হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ। প্রতি বছর এসব ভেজাল আম চিহ্নিত করে বুলডোজার দিয়ে পিষে ধ্বংস করতে দেখা যায় এবং জরিমানা করা হয়। যেটা সবার জন্য দৃষ্টিকটু ব্যবসায়ীদের জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিকর।

এসব প্রতারণা ও ক্ষতি ঠেকাতে সরকারীভাবে নির্দিষ্ট সময়ে আম পাড়ার জন্য ক্যালেন্ডার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। একেক জাতের আমের জন্য একেকটি সময়সীমা বা লগ্ন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম মের ৪ তারিখ গুটি আম ও সর্বশেষ আগস্টের ২০ তারিখ ইলামতি আম পাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে পরিপক্ব ও সুমিষ্ট আম হাতে পেয়ে ভোক্তা অধিকার কিছুটা সংরক্ষিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির আচরণে অনেক বৈসাদৃশ্য শুরু হওয়ায় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আম পরিপক্ব হচ্ছে না। আম পাড়ার জন্য তৈরি ক্যালেন্ডারে এবছর প্রথমেই গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, গুটি আম পাড়ার জন্য মে মাসের ৪ তারিখ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী এলাকার গুটি আমে পরিপক্বতা আসেনি বিধায় আমচাষীরা কেউ গুটি আম পাড়েননি। অভিজাত আমের রাজধানী বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষীরা বলেছেন, আমাদের এলাকায় গাছে আম পাকা শুরু হলে তারপর আম নামানো হবে। তাই এবছর আম পাড়ার নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে বিপত্তি দেখা দিয়েছে।

অপরদিকে বর্তমান রংপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও পার্বত্য চট্টগ্রামে এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও সূর্যাপুরি সুস্বাদু আমের বাজারে বিশাল জায়গা করে নিয়েছে। এগুলোর উৎপাদন, বিপণন ও ভোক্তা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু আম পাড়ার ক্যালেন্ডারে ক্রমবর্ধিষ্ণু এসব আমের উল্লেখ নেই বলে তারা কিছুটা হতাশ।

আমের মৌসুম শুরু হলেই কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা সরব হয়ে ওঠে। অনেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে অভিজাত আম পাঠায়। কেউ কেউ নেতা-মন্ত্রী বা চাকরিস্থলের বড় বসকে খুশি করার জন্য কুরিয়ারে আম পাঠানোর আব্দার মেটাতে গিয়ে হিমশিম খায়। কারণ, তাদের ভালো জাতের আম ও পরিমাণে বেশি করে পাঠাতে হয়।

এটা ঠিকমতো মেটাতে না পারলে অনেক সরকারি চাকুরের প্রমোশন ও ভালো জায়গায় বদলি হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আমের জেলাগুলোতে মানুষের আনাগোনা বাড়ে, বহু শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়, বাজারে গতি বাড়ে, স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। রাজশাহী এলাকায় প্রতি বছর ‘ম্যাঙ্গ ট্যুর’ গতিপ্রাপ্ত হয়।

করোনার সময় থেকে অনলাইনে আম কেনাবেচার প্রবণতা শুরু হলেও বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে আম কেনাবেচার ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ভিডিওকলের মাধ্যমে সরাসরি আমের বাগান থেকে পছন্দনীয় জাত ও গাছের আম পাড়া, ওজন দেওয়া, প্যাকেটজাত ও প্রেরণ করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এজন্য বাগানে আমের মুকুল আসার পর থেকে ভিডিও দেখিয়ে ক্রেতা আকর্ষণ করে তার ফলোআপ করার মাধ্যমে অগ্রিম বিক্রির চুক্তিও করেছে কিছু অনলাইন প্রতিষ্ঠান।

আমের বাজারে গুণগত মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এবং ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই ব্যবস্থা খুবই আশাপ্রদ। অনলাইনে আম, লিচু ও বিভিন্ন মৌসুমি ফল বিক্রি করতে গিয়ে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেকের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

শুধু রসালো তাজা আম বা মিষ্টি ফলই নয়, ফলের জুস, আচার, আমসত্ত্ব, লজেন্স, ম্যাঙ্গবার ইত্যাদির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কারখানা তৈরিতে সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বেকার যুবকদের জন্য সহযোগিতা বাড়ানোর চিন্তা করা প্রয়োজন। এটা আরও বিস্তৃত হলে আমের বাজারে ভোক্তা প্রতারণার প্রবণতা কমে যাবে, অসৎ ফড়িয়াদের অনৈতিক দৌরাত্ম্য দূর হবে এবং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কিচুটা হলেও তৈরি হবে।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো পেরিয়ে উন্নত জাতের আম এখন সারাদেশে চাষ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে মৌসুমের সময় রসালো ফলের দাম অনেক কমে যায়। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, তরমুজ প্রভৃতি রসালো ফলের প্রক্রিয়াজাত কারখানা খুব কম থাকায় প্রতি বছর আমাদের বিদেশি ফলের জুস আমদানি করতে হয়।

নিজেদের মাটিতে এত পুষ্টিকর ফল উৎপাদন হলেও শুধু প্রক্রিয়াজতকরণ ও সঠিক সংরক্ষণের অভাবে আমাদেরকে থাইল্যান্ডের আম, লিচু ও পেয়ারার জুস বাজার থেকে কিনে খেতে হয়। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে দাবী করার পর এসব বিষয় আমাদের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।

অধুনা বারোমাসী আম বলে ফরমালিনযুক্ত আম সারাবছর বাজারে পাওয়া যায়। প্রতিবেশী দেশের অপরিপক্ক আম আমাদের বাজারে অবৈধভাবে ঢুকে বারোমাসী আম বলে রাজধানীর অনেক অভিজাত মার্কেটে অসময়ে বিক্রি হতে দেখা যায়।

এই অসাধু প্রবণতা রোধ করার জন্য সরকারী কর্তৃপক্ষকে সজাগ হতে হবে। এসব অপুষ্ট মৌসুমি ফলের অবৈধ ব্যবসা ঠেকানো জরুরী। তা-না হলে আমাদের দেশী আমের বাজার ক্ষতির সন্মুখিন হবে এবং যেটা আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিস্বরুপ। বিশেষ করে শহুরে ধনী পরিবারের শিশুরা এসব ফলের বড় ভোক্তা হয়ে থাকে।

এছাড়া দিনক্ষণ বেঁধে দিয়ে আম পাড়ার ক্যালেন্ডার তৈরি করা হলেও প্রকৃতির নিয়ম আলাদা হতে পারে। সেজন্যই হয়তো এবছর আম পাড়ার প্রচারিত সরকারি তারিখ বা নির্দিষ্ট লগ্ন নিয়ে প্রশ্ন ও বিপত্তি দেখা দিয়েছে। তাই প্রতি বছর কোন জেলার বা ভৌগোলিক এলাকার জলবায়ু, পরিবর্তিত পরিবেশ এবং স্থানীয় কৃষকদের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে ফল পাড়ার ক্যালেন্ডার সাজাতে হবে।

এ ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গাছ থেকে পরিপুষ্ট ফল পেড়ে বাজারজাত করণ ও সেটা ভোক্তার হাতে সহজে পৌছানোর ব্যবস্থা করতে সরকারী নীতি-নির্দেশনাকে বেশি নমনীয় হতে হবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এমএস