ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে জুয়েলারি শিল্পে কর সুবিধা জরুরি

কে. এম. রাহাত ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ২১ মে ২০২৩

সোনা! হলুদ মূল্যবান ধাতু, যা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে আভিজাত্য, ক্ষমতা ও নারীর অলংকার হিসেবে। বাংলার প্রাচীনতম শিল্প স্বর্ণশিল্প। কালের বিবর্তনে নারীর অলংকারের পাশাপাশি সোনা হয়ে উঠেছে, উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখার অন্যতম হাতিয়ার। বিনিয়োগ, রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার এই মূল্যবান হলুদ ধাতু। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও, এই জুয়েলারি খাত নীতিনির্ধারকদের কাছে অবহেলিত। বাংলার স্বর্ণশিল্পীদের হাতে তৈরি গহনা বিশ্বের সব দেশে সমানভাবে সমাদৃত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নীত হয়েছে, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে। এই অবস্থান ধরে রাখতে হলে জাতিসংঘের দেওয়া শর্তগুলো ২০২৬ সালের মধ্যে পূরণ করে ২০৩১ সাল পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন সূচক বজায় রাখতে হবে। এই শর্ত পূরণে অন্যতম দু’টি বাধা হলো এক. রপ্তানি খাতের বিকাশ এবং দুই. সঠিক খাতে মূলধন বিনিয়োগ ও তারল্যের সঠিক প্রবাহ।

অথচ আমাদের দেশ শুধু একটি শিল্পকেন্দ্রিক রপ্তানিনির্ভর হয়ে আছে এবং বৈশ্বিক মন্দার বাজারে নেই কোনো নতুন মূলধন বিনিয়োগ। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের রিপোর্ট মোতাবেক ২০১১ সালে দেশের জিডিপিতে রপ্তানির অবদান ছিল ১৫ শতাংশ, যা ২০২১ সালে নেমে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। আমাদের রপ্তানি খাতের মোট আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

বিশ্ব বাজারে আর্থিক মন্দা ও ডলার সংকট, কোভিড-১৯ এর আক্রমণ এবং পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে বিপৎগ্রস্ত করে তুলেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগে হাজারো নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল, আমদানির ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক শুল্ক হার দেশের আর্থিক সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যাচ্ছে। যার প্রভাব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্যের সংকটের মাধ্যমে আমাদের কাছে প্রকট হয়ে ওঠে।

বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে কাতার, হংকং, চায়না, ভারত যেখানে সোনাকেন্দ্রিক পুঁজিবাজার তৈরি করেছে এবং নিজস্ব মুদ্রায় সোনার স্ট্যান্ডার্ড বানিয়ে আমদানি মূল্য পরিশোধ ও বিনিয়োগের একটি বড় মাধ্যম তৈরি করেছে, সেখানে বাংলাদেশে তেজাবি বা পিওর সোনা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে বার্ষিক সোনার চাহিদা ৪০ টন (বেসরকারি মতে যদিও তা ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি), সেখানে পুরো স্বর্ণশিল্প দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার এবং ভোক্তাদের কাছ থেকে পুরাতন সোনা পরিশোধনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্যমতে, বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড জুয়েলারি আছে প্রায় ৪০ হাজার। সঠিক কাগজপত্র প্রদর্শন করার পরও বৈধভাবে এই জুয়েলারি খাত সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে, ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় গড়ে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের অস্বাভাবিক শুল্ক-করের বোঝা।

একটি শিল্পের সর্বশেষ উৎপাদিত পণ্যের দাম তখনই কমানো সম্ভব হয়, যখন তার সাথে সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ ও কাঁচামালের ওপর আরোপিত শুল্কের পরিমাণ কম হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সোনার অলংকার তৈরির প্রত্যেক ধাপে ধাপে মূল্য সংযোজন হতে হতে সর্বশেষ উৎপাদিত পণ্যের দামের পার্থক্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে দাঁড়ায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়।

২০২৬ সালের মধ্যে সরকার ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে জুয়েলারি শিল্প হতে পারে সরকারের তুরুপের তাস। কারণ এই শিল্পের জন্য নতুন অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কৃপা দৃষ্টি এবং শুল্ক হার কমানো ও কর অবকাশ প্রদান। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের স্থানীয় বাজার ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মূল্যমানে দাঁড়িয়েছে।

সময় এসেছে সোনা শিল্পের দিকে সরকারের নজর দেওয়ার। আমাদের কাছে আছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সোনার কারিগর, যাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন সব অলংকার। সরকারের সঠিক নীতিমালা ও যথাযথ প্রণোদনা, এই শিল্পের স্থানীয় মার্কেটকে উন্নীত করতে পারে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার মার্কেটে। এর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করতে পারলে, এই খাত থেকেই রপ্তানি আয় দাঁড়াবে ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা রপ্তানি খাতকে বহুমুখী করার ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ হিসেবে পরিলক্ষিত হবে।

২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের রিপোর্ট মোতাবেক, বিশ্ব বাজারে সোনার চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৭৪০ টন, যার মধ্যে সোনার বিনিয়োগে চাহিদা ১ হাজার ১০৬ দশমিক ৮ টন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ছিল ১ হাজার ১৩৫ দশমিক ৬ টন। আমরা যদি বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে চায়না, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ভারত, ব্রাজিল, তুরস্ক ও কাতারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার এই বাজারেও তাদের গোল্ড রিজার্ভ বাড়াচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের রিপোর্ট মোতাবেক ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ চাহিদা ছিল ৪৫০ দশমিক ১ টন, যা ২০২২ সালে ১৫২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৫ দশমিক ৭ টন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এসব দেশের বুলিয়ন মার্কেটে তাদের বড় ক্রেতাই হচ্ছে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো, যা সেসব দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

১৯৮৪ সালেও আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো সোনা জমা রাখাপূর্বক ঋণ প্রদান করতো। আজ প্রায় ৪০ বছর ধরে সে সুযোগও বন্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড কর্তৃক ১৮ শতাংশ সুদ হারে সোনা বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়া হয়। সোনা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের সঞ্চয়ের প্রধান মাধ্যম। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পুঁজি সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম হতে পারতো এই হলুদ মূল্যবান ধাতু। ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদানসহ, পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ এবং আমদানি মূল্য পরিশোধ করার ক্ষেত্রে মুদ্রার বিকল্প হতে পারতো এই হলুদ প্রাচীনতম মূল্যবান ধাতু।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সোনা লেনদেনের সুযোগ প্রদান করা হলে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থ প্রবাহের ভারসাম্য বজায় থাকার পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে সোনা জামানত রেখে ঋণ প্রদানে উৎসাহিত হবে। এবং ঋণখেলাপির পরিমাণও কমে আসবে। অন্যদিকে সরকার কর্তৃক অস্বাভাবিক শুল্ক হার কমিয়ে, বিশ্বের অন্য দেশের সাথে শুল্ক হার সমন্বয়ের মাধ্যমে এই জুয়েলারি শিল্প বড় পরিসরে গঠনে ভূমিকা পালন করবে। যেখানে কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের।

জুয়েলারি খাতকে উন্নত করার ক্ষেত্রে, প্রথমেই উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে দামের সমন্বয় করতে হবে। ইন্টারমিডিয়েট কাঁচামালের জোগান নিরবচ্ছিন্ন রাখার ক্ষেত্রে, জুয়েলারি শিল্পসংশ্লিষ্ট সব ধরনের প্রাথমিক কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্কের ক্ষেত্রে ১০ বছরের কর অবকাশসহ; সব যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্ক হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান মিলে সাপ্লাই চেইন তৈরি করা। এর আওতায় ইকোনমিক প্রসেসিং জোন করা হলে, বড় বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে।

আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হলে, দেশে সোনা পরিশোধনের ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাবে। দেশে সোনাকেন্দ্রিক পুঁজিবাজার তৈরি, তেজাবি বা পিওর সোনা বিক্রির ক্ষেত্রে বৈধতা প্রদান, ট্যারিফ কমিয়ে এবং নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারের আওতায় আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন এই শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ব্যাগেজ রুল এবং ব্যক্তি কর্তৃক বহন করা সোনা দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সোনা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কাগজপত্র সহজীকরণ এবং ওয়্যারহাউজ সুবিধা প্রদানও জরুরি।

লেখক: গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশন (বাজুস)।

এইচআর/ফারুক/এমএস