ফারাক্কা লংমার্চ অতীত ও বর্তমান
আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে মে ১৬, ১৯৭৬ ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। যারা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর পানিসুবিধা থেকে বঞ্চিত এ দিনটিতে তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানিসুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের মানুষ বহুযুগ আগে থেকে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারত আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে বেশি হুমকির সন্মুখিন করে তুলেছিল-যা অদ্যাবধি আছে। ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মাওলানা ভাসানী এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে।
এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত-পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়ে চালু হবার অপেক্ষায় থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।
মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হবার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের কৃষি, জীবৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তাঁর এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেইট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানির হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।
এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লিখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দেলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।”(বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।
এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানীর প্রত্যুত্তর ছিল, “আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার উপর সরকারী ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপূরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরুপ প্রত্যাশা ছিল না।”এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানির দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।
এই লংমাচ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন। এসময় ৯০ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানী বেশ অসুস্থ ছিলেন। তাঁর অনবরত প্রসাব হচ্ছিল। তবুও তিনি দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।
মাওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।” তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং “আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।”লংমার্চকারীদের সাথে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাবার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
এর প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালেবাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়ার মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদী গঙ্গাচুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তবে গঙ্গাচুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কি পেয়েছে বাংলাদেশ তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কিভাবে করা হবে তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।
মেয়াদোত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে কি-না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যে কোন বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা।
অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশরে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সাথে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সব ধরনের মাছের আকাল দেখা দিয়েছে।
এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পেশা বন্ধ হয়ে জেলে, মাঝিমাল্লা, নৌশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। পদ্মার শাখা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণ ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’- এখন পদ্মা ও তার শাখানদীগুলোর জন্য চরম সত্যবাক্যে রূপ নিয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজের বিরুপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী যা বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে উপস্থাপিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে প্রায়শই দেশে বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়।
ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নানা সুপারিশ প্রদান করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। এমনকি তিস্তা নদীর পানিবন্টন সমস্যা নিয়ে শত শত মিটিং- সেনিার, চুক্তি হবার পরও অদ্যাবধি ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসেবের গড়মিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বার বার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছে। তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মাওলানা ভাসানীর সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি। আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়।
নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানীর মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ- সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/এমএস