কেন তারা হয়ে গেলো মুক্তি?
বখাটের দায়ের কোপে নেত্রকোনার বারহাট্টায় স্কুলশিক্ষার্থী মুক্তি বর্মণ হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে ১৯ বছর বয়সী আসামি কাওসার। গ্রেফতারের পর খুনির ছবি ও ভিডিও দেখে মনে হয়েছে তার মধ্যে কোনো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অনুশোচনার বালাই নেই। অনেকটাই স্বাভাবিক। থানায় নেওয়ার আগেই হাসতে হাসতে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছে।
দরিদ্র পরিবারের ছয় বোনের একজন ছিল দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুক্তি। বাল্যবিবাহ ও ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সরব ছিল তার কণ্ঠস্বর। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা পরিবারে জানাজানি হওয়ায় সংক্ষুব্ধ হয়ে তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে কাওসার।
কথা হলো এই বয়সের একটি যুবক মানুষ হত্যা করার মতো সাহস করেছে! এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে। সমাজে এ ঘটনা আসলে কীসের আলামত? হত্যার বিচারের দাবির পাশাপাশি এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও সমাধানের গুরুত্ব কোনো অবস্থায়ই কম হতে পারে না।
সভ্য সমাজে এই বয়সের একটি যুবক মানুষ হত্যা করতে পারে বিষয়টি কল্পনা করলেই তো গা শিউরে ওঠার অবস্থা তৈরি হয়। যার এখন পুরোপুরি বড় হওয়া, আলোকিত মানুষ হওয়ার যুদ্ধে থাকার কথা- তার বিরুদ্ধে এখন হত্যার অভিযোগ। কলুষিত সমাজের এর চেয়ে বড় ও নির্মম আর কোনো উদাহরণ হতে পারে না। কেন এই যুবক মানুষ হত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়েছে? কেন এমন মানসিকতা অল্প বয়েসে তৈরি হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আগে বের করতে হবে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা ও সভ্যতা বিবেচনায় সমৃদ্ধ দেশগুলো অনেক এগিয়ে। সেখানের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। তারপর স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে প্রকৃত বিষয় বের করে এনে কার্যকর দাওয়াই নিশ্চিত করে। অর্থাৎ এ ধরনের দু-একটি ঘটনাকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে সেসব দেশ বিবেচনা করে না।
এরকম একটি ঘটনাই রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো; যে কারণে এ ঘটনা ঘটেছে, সমাজে অন্যদের মধ্যেও যদি এর প্রভাব পড়ে? অথবা আর কজন এ ধরনের ভয়ঙ্কর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তাই তাদের চিহ্নিত করে কাউন্সিলিংসহ সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। যার ধারে কাছে আমরা নেই।
মুক্তি হত্যাকারীর ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা দরকার তা হলো, নাবালক, গাগল, প্রতিবন্ধী বলে তাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চিন্তা যেন কারও মাথায় না আসে। এসব রক্ষাকবচ ব্যবহারে তাকে পার করে দেওয়ার মানেই হলো, হিংস্র হত্যাকারীকে সমাজে লালনপালনের সুযোগ করে দেওয়া। সে ভবিষ্যতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠতে পারে। এরকম আরও জীবন নিতে তার হাত কেঁপে ওঠার কথা নয়। তাছাড়া সমাজের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো ‘প্রভাব’ হত্যাকারী বা অপরাধীর পক্ষ নেওয়া।
যদি কাওছারের আত্মীয় বা পরিচিতজনদের মধ্যে কেউ রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী থেকে থাকে তাদের উচিত আইনকে স্বাভাবিক নিয়মে চলার সুযোগ করে দেওয়া। কোনো অবস্থায়ই বিচারকে প্রভাবিত করে খুনিকে রক্ষা ঠিক হবে না। এতে রক্ষাকারীরাও একদিন বিপদের সম্মুখীন যেমন হতে পারেন, তেমনি তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটনা ঘটে?
কাওছার বেপরোয়া হয়ে ওঠার দায় পরিবার, সমাজ, রাজনীতি তথা রাষ্ট্র কোনোাভাবেই এড়াতে পারে না। সমাজ ও রাজনীতির নেতিবাচক নানা বাস্তবতা থেকেই তার মধ্যে দুঃসাহস জন্ম নিয়েছে। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয়ে ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ ঘটেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতার প্রভাব, সামাজিক অপরাধ ও হানাহানি, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন দিন দিন বাড়ছে।
পরিবার-গ্রামে বড়দের মান্য করার বিষয়টি কার্যত ওঠে গেছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ছাত্রদের শাসন করলে পরিদিন পরিবারের লোকজন দল বেঁধে শিক্ষকের বিচারের জন্য ছুটে যান। সর্বোপরি অপরাধকে আশ্রয়, প্রশ্রয় দেওয়ার নজির বেশি। যুবকদের হাতে অর্থেরও কোনো অভাব নেই। তাই সে নিজের ইচ্ছেমতো চলে, যা খুশি তাই করার সুযোগ পায়।
গ্রামের ভালো মানুষগুলো অপসংস্কৃতির কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তারা আর কোনো কিছুতেই মাথা ঘামান না। সর্বোপরি অবাধ তথ্যপ্রবাহ, মোবাইল ও ইন্টারনেট নতুন প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার সবশেষ পেরেক হিসেবে কাজ করেছে। জুয়া আর নেশা গ্রাস করছে উঠতি বয়সীদের। এসব কারণে পরিণত বয়সের পর অনেক পরিবার চাইলেও ছেলেমেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না।
অর্থের অভাব থাকলেও নবম শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে মোটরসাইকেল কিনে দিতে হয়। সন্তানের হিরো ইজমের কারণে একের পর এক অঘটন ঘটায়। এসব কারণে গ্রামের বিচার-শালিসে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এমনকি ১৮ বছরের আগেই ছেলেমেয়ের বিয়ের আবদার পূরণ করতে হয়। এজন্য ছেলেবেলার প্রকৃত পারিবারিক শিক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত অভিভাবকদের। সর্বোপরি অভিভাবকরা যদি ভালো হন, তবেই সন্তানকে ভালো করা সম্ভব। অন্যথায় এরকম অঘটন একের পর ঘটতেই থাকবে। সমাজ আরও বেশি অন্ধকারের দিকে যাবে। তাই সবার উচিত ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা, এতে সহযোগিতা করা। বিচার নিশ্চিতে সামাজিক চাপ বাড়ানো, যা সমাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
নতুন প্রজন্মই একটি দেশের ভবিষ্যৎ চালিকাশক্তি। তারা সমাজে আলো ছড়াবে। উন্নয়ন, অগ্রগতি, অর্জন আর এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে ভালো কাজে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে। পরিবর্তন আনবে রাজনীতিতে। এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু দিন দিন সন্তানদের মানুষ হিসেবে বড় করে তোলা সব অভিভাবকের জন্য মহাচ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটা বিপজ্জনক বাস্তবতা হলেও হতাশার কিছু নেই। সাহসের সঙ্গে সন্তানকে সুনাগরিক করে তোলার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে। কারণ আপনি, আমি কিংবা আমরা প্রত্যেকেই যদি হেরে যাই তাহলে দেশ হারতে হারতে পিছিয়ে যাবে। আমাদের সামনের সব আলোগুলো একে একে নিভে গিয়ে মহাঅন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হবে, যা থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো পথ থাকবে না।
বড় হয়ে মুক্তি কি না হতে পারতো? অনেক কিছুই হতে পারতো সে। কারণ এই বয়সে বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং প্রতিরোধসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিল এসএসসির এই পরীক্ষার্থী। তার মধ্যে ভালো কিছু কাজ করতো। সুন্দর সমাজ ও আগামীর জন্য যে জীবনের শুরু থেকেই কাজ করে, সে কোনোদিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। সচেতন মানুষের সফলতা অনিবার্য। তা আর হলো না। সবার চোখের সামনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো তাকে। আকাশের তারা হয়ে নদীর জলে মিশে গেছে মুক্তির স্বপ্ন। এরচেয়ে হৃদয়বিদারক আর কী হতে পারে?
বাবা-মাসহ পরিবারের লোকজন এই শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন? এক্ষেত্রে প্রশাসনসহ সমাজের সবাইকে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। অপরাধীর কঠোর বিচারের প্রতিশ্রুতি পেলে নিখিল বর্মণের অন্য সন্তানরা স্বাভাবিকভাবে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। মুক্তির অভাব কিছুটা হলেও গুছিয়ে দেবে সবাই মিলে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ দেশ ও সমাজসহ বেড়ে ওঠার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে সবার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম