বিদেশে দেশীয় রাজনীতি কেন?
আমাদের রাজনীতি যে ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে এবং সেটা যে স্থান বা কাল মানেনা তার প্রমাণ আরেকবার পাওয়া গেল। দেশে তো বটেই, বিপরীত মতকে গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে ব্যর্থ আমরা বিদেশের মাটিতেও। ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কর্মসূচির সময় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে মারামারি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে মার্কিন পুলিশকে।
এই উগ্রতা গণতন্ত্রের পক্ষে প্রাণঘাতী এবং দেশের ভাবমূর্তির জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক আদর্শের সাথে যত মতবিরোধ থাকুক, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তার একটি আনুষ্ঠানিক সফরের সময় একজন বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে কীভাবে বিদেশের মাটিতে বিক্ষোভ করা যায়, সহিংস আচরণ করা যায়, কিভাবে কুরুচিপূর্ণ শ্লোগান দেয়া যায় সেটা বিএনপিসহ বিরোধী রাজনীতি যারা করেন তারাই কেবল বলতে পারবেন। আবার দলীয় ব্যানারে সংবর্ধনা না হয়ে কেন প্রবাসী সব বাংলাদেশ নাগরিকদের ব্যানারে হল না সেটাও কেউ বলবে না। এ রাজনীতি যে আরও হিংসাত্মক হয়ে উঠছে এসব ঘটনা তার বিপজ্জনক উদাহরণ।
বিদেশে এভাবে দেশের রাজনৈতিক দলের শাখার প্রয়োজন কেন? এমন প্রশ্ন আমি বহু বড় নেতাকে করেছি। তারা কেউই সদুত্তোর দিতে পারেননি। নির্বাচন কমিশন আইনে কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা বা অফিস খোলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বিদেশ বা প্রবাস শাখার কোনো বিধান নেই। বিএনপির গঠনতন্ত্রেও নেই। তবুও শাখা আছে, আরও অনেক দলের আছে। এসব কমিটি অনুমোদন এবং গঠন করা হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে বা মৌখিকভাবে। কোনো কোনো দেশে একই দলের একাধিক শাখা ও কমিটিও আছে।
এসব কমিটি গঠন নিয়ে রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধের খবরও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। আর প্রতিপক্ষের সাথে সংঘাত তো নিয়মিত। বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্কে দেশের যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি মিছিল, মিটিং, হুমকি, পুলিশ ডাকাডাকি সাধারণ বিষয়। প্রবাস জীবনে দেশের রাজনীতি চর্চায় বাংলাদেশিরা অন্য যে কোনো অভিবাসী জনগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়।
সম্প্রতি কানাডা সফরকালে সেখানকার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের অনেকেই আমার কাছে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। তাদের কথা হলো যদি করতেই হয় তাহলে এখানকার মূলধারার রাজনীতি করুক যেমনটা করছে ভারতীয়রা। কানাডার বর্তমান সরকারের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং এমপির সংখ্যাও অনেক।
সেসব দেশে স্থায়ী বসবাস করে, ব্যবসা করে, চাকরি করে, নাগরিকত্ব নেওয়া- তারপরেও দেশের রাজনীতিতে এত কেন উৎসাহ? উত্তরে তারা বলবেন দেশের প্রতি দায়িত্ব আর ভালোবাসা থেকেই তারা এটা করেন। কিন্তু দেশপ্রেমই যদি থাকবে তাহলে সংঘাত করে, সহিংসতা করে, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে দেশের বদনাম করা হচ্ছে কেন? আসলে, বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত স্বার্থ কাজ করে। প্রবাসে দলের পেছনে সময় দিয়ে, অবস্থান সৃষ্টি করে দেশে গিয়ে নির্বাচন করার তাড়না কাজ করে। এবং অনেকে সেটা করে সফলও হয়েছেন।
আরেকটা হলো, এসব প্রবাসী নেতারা যেহেতু ভাল অর্থ-বিত্তের মালিক, এদের প্ররোচনা দেন দেশের কিছু নেতা-নেত্রী। দেশে থাকা নেতা নেত্রীরা নিজেদের স্বার্থেই বিদেশে নিজ নিজ দলের তৎপরতা নিয়ে উৎসাহী হন। বিদেশে দলের শাখা থাকলে নেতারা সেখানে গিয়ে কিছু সেবা, সুবিধা পান, আরাম আয়েশে থাকতে পারেন, ফেরার সময় দামী সব উপহার বা নগদও নিয়ে আসতে পারেন।
বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি করার এই প্রবণতা প্রবীণ ও মধ্য বয়সীদের মধ্যে বেশি। এদের একটা বড় অংশই দেশে রাজনীতি করে গেছেন। নতুন প্রজন্মের ভাবনা ভিন্ন। বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি নিয়ে তোলপাড় করার এই প্রবণতাকে পছন্দ করেন না অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী ভারতের। পাকিস্তানিও অনেক। ইদানীং নেপালীদের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশিদের মধ্যেও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। যতবারই দেশের বাইরে গেছি, প্রবাসী যারা আছেন তাদের অনেকেই এই রাজনৈতিক তৎপরতায় তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন।
পশ্চিমাদের মধ্যে বহু নাগরিক বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তারা তো বটেই, এমনকি আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়া বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবাসীরাও একে অপরের সাথে মারামারি বা রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং করে না। তারা এমন কিছু করে না যা তাদের দেশের জন্য অসম্মান বয়ে আনে। শুধু বাংলাদেশিরাই এর বিপরীত। বিদেশে বা উন্নত দেশে থাকার শর্তেও তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আনেনি।
সত্যি বলতে কি ইউরোপ, লন্ডন, আমেরিকা, কানাডায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা অন্য দলের কমিটি থাকায় বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যকার নিজেদের ভালোবাসাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কেবল আছে গীবতে চর্চা। সেসব দেশের নাগরিকরা এবং সরকারগুলোও বাংলাদেশ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পাচ্ছে।
বিদেশের মাটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটাই পরিচয় হওয়া উচিত যে তারা বাংলাদেশি। তাদের কাজই হওয়া উচিত বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে এই প্রবাসীরা ক্রমেই যে বাংলাদেশ বিদ্বেষী হয়ে উঠছেন, সে কথা কি ভাববেন?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস