‘নয়-ছয়’ উঠে গেলে শেয়ারবাজার কি চাঙা হবে?
বছর তিনেক হলো শিল্পঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার নয় এবং ছয় শতাংশের মধ্যে আটকে থাকলেও এবার উন্নয়ন সহযোগীদের চাপে সেখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আসছে জুলাই থেকে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে তিন শতাংশ যোগ করে পদক্ষেপের শুরুটা হচ্ছে। পরবর্তীতে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করবে। যদিও গাড়ি, বাড়ি, ব্যক্তিগতসহ বিভিন্ন ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট হার ৯ শতাংশ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আরও আগেই।
রিজার্ভে ধস ঠেকাতে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি ঋণের সুদের হারও বাজারভিত্তিক করার শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও প্রত্যাশিত বিনিয়োগ লাভের জন্য অন্য দুই ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির পূর্বাভাসে সুদের হার বাজারভিত্তিক ও নমনীয় করার জোর তাগিদ দিয়েছে।
সুদের হার নির্ধারিত জায়গায় আটকে থাকা অর্থাৎ শিল্পপতিরা ৯ শতাংশ হারে ঋণ পাচ্ছেন বটে তবে একই সঙ্গে বাজারে অতিরিক্ত অর্থপ্রবাহ তৈরি হয়েছে। অল্প সুদের ঋণ নিয়ে সোনার গহনা, গাড়ি, দামি ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন বিলাসপণ্য কিনছেন। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ানোর যে চিন্তা থেকে সুদের হার ৯ শতাংশে নামানো হয়েছিল তার ফলাফল খুব একটা ইতিবাচক নয়। উল্টো ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়ে সমস্যা তৈরি করছে অর্থনীতিতে।
আবার আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশে আটকে থাকায় আমানতকারীদেরও ব্যাংকে টাকা রাখার আগ্রহে ভাটা তৈরি হয়েছে। ফলে গ্রাহকের কাছে নগদ টাকা জমতে শুরু করে। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতির সংকট তৈরি হয়েছে।
এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটে আমদানি ব্যাহত হওয়া এবং আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে গেছে। গেল এক বছর ধরেই এই মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য, সর্বশেষ মার্চ মাসেও খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯ শতাংশে ঠেকেছে যেখানে আগের মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদের হার বেশি হলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় অর্থাৎ টাকার মূল্য কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতেও কেন সুশাসনের ঘাটতি?
বাজারে টাকার সরবরাহের লাগাম টানতে এর আগে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি ঘোষণায় ব্যাংকের রেপো রেট (যে সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়) বাড়িয়ে টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই ব্যবস্থাটি এখন পর্যন্ত বাজারে টাকার সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, পরিবারের বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, আবার কারও কারও তোষকের নিচেও টাকা জমেছে। নির্ধারিত আয়সীমার লোকেরা টাকা সঞ্চয় করতেও পারছে না। সবচেয়ে ভোগান্তিতে আছে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের জরিপ বলছে, গেল ছয় মাসে নিম্ন আয়ের মানুষের ধার করে জীবন চালানোর প্রবণতা বেড়েছে। যদিও, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমা এবং সাথে আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়।
পুঁজিবাজারে কী হবে?
তাই একদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের শর্তপূরণ, মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ছন্দময় রাখতে জুলাই মাসে সুদের হারে নয়-ছয় তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমানতকারীরা হয়তো বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংকে টাকা জমা রাখার আস্থা ফিরে পাবেন। ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটবে এবং বিনিয়োগকারীরাও ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ঋণের সরবরাহ পাবে। তবে সুদের হার বাড়লে ব্যবসার খরচ বাড়বে। যদিও মনে রাখা দরকার, দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অর্থায়ন উৎস হিসেবে ব্যাংক উৎকৃষ্ট মাধ্যম নয়। মূলধন জোগান পেতে যেতে হয়ে পুঁজিবাজারে।
সুদের হার নমনীয় হলে পুঁজিবাজারে তার কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। সুদ থেকে বাড়তি মুনাফার আশায় তখন মানুষ কি বাজারের লগ্নি ভেঙে ব্যাংকে বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি আমানতের টাকা জমা রাখবেন- নাকি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বাড়াতে শুরু করবেন? পুঁজিবাজার একটা ঝুঁকিপুর্ণ জায়গা। একমাত্র যারা বুঝেশুনে বিনিয়োগ করতে পারেন তারাই এখান থেকে সম্পদ বৃদ্ধি ও মুনাফা ঘরে তুলতে পারেন। ব্যাংকে আমানতের মুনাফার হার বেশি হলে স্থায়ী কিংবা সঞ্চয়ী আমানতের পরিমাণ বাড়বে বলে মনে করা হয়। তবে আমানতের সুদের হার কত শতাংশ হবে তা নির্ভর করবে ব্যাংকগুলোর তহবিল চাহিদার ওপর, বিনিয়োগের পরিবেশ ও ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে।
বিদ্যমান আর্থিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের তুলনায় মেয়াদি আমানতের পরিমাণ কম। তারপরও পুঁজিবাজারের মন্দাভাব কাটছে না। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম ধরে রাখা হয়েছে অনেক কোম্পানির। আস্থার সংকট, বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত মুনাফা না পাওয়ার শঙ্কার ফলেই বাজার মূলধন বাড়ছে না। গুটিকয়েক কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দিলেও অনেক কোম্পানি আছে দুর্বল অবস্থায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ব্যাংকে টাকা জমা রাখার পরিবর্তে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
একটি শক্তিশালী ও স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থার সাথে বিনিয়োগের পরিবেশ সম্পর্কিত। এতে উৎপাদন বাড়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং প্রবৃদ্ধিও এগিয়ে যায়। তবে বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ হলে সুদের হার ১৪/১৫ এ গিয়ে ঠেকলে কোম্পানিগুলোর পরিচালন ও মূলধন খরচ বেড়ে যাবে। তাই বন্ড কিংবা শেয়ারমূলধন বিক্রি করে বিনিয়োগের টাকা সংগ্রহ করা ব্যাংকের বিকল্প ব্যবস্থা। স্টক একচেঞ্জগুলোতে প্রচলিত ইন্সট্রুমেন্টের বাইরেও রয়েছে ইসলামিক বন্ড বা সুকুক, গ্রিন বন্ডসহ দীর্ঘমেয়াদি মূলধন জোগার করার বিভিন্ন উপায়। তবে পুঁজিবাজারে যেতে কোম্পানিগুলোকে মানতে হবে তালিকাভুক্তির সব শর্ত।
কিন্তু যারা এই পথে আসতে চান না, তারাই সুদের হার বেশি থাকার কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল- এই যুক্তি দেখিয়েই সরকারকে বাধ্য করেছিল সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনতে। কিন্তু মুক্তবাজারে এমন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অনেকদিন ধরেই সুদের হার বাজারে ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ আসছে।
পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে চাইলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতেই হবে। সঞ্চয় বাড়লেই কেবল তার একটি অংশ বিনিয়োগ আকারে ফিরতে পারে। অন্যদিকে, আমানত সংগ্রহের খরচ বাড়লে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢালাওভাবে অলস টাকা পুঁজিবাজারে খাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। আবার নির্ধারিত বেঁধে দেওয়া সুদের হার তুলে দিলে যদি মূলধন খরচ ও ব্যবসা পরিচালনা খরচ বেড়ে যায় তাহলে কোম্পানির মুনাফা কমে গিয়ে ছোট বিনিয়োগকারীদেরও লাভের অংক কমবে বৈকি।
তাই মুনাফার ধারায় থাকা ভালো কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি লেনদেনে কারসাজির অভিযোগ শূন্যের কাছে নামিয়ে আনলেই পুঁজিবাজার নিয়ে আস্থার সংকট ও লেনদেনের খরা কাটবে।
লেখক: সাংবাদিক, চার্টাড সেক্রেটারি।
এইচআর/বিএ/এমএস