ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও এ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০২৩

 

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদের মেয়াদকাল শেষে ২৪ এপ্রিল মো. সাহাবুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে তার এই দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে উষ্ণ অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা।

মো. সাহাবুদ্দিন এমন এক সময়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন যখন সদ্য সমাপ্ত মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশের মানুষ অনেকটা ফেস্টিভ মুডে আছে। এটা এমন একটি মুহূর্ত যখন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ– যারা কি না ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম– সব ভেদাভেদ ভুলে একই ঈদগাহে একত্রে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে সবাই মিলে দেশ ও দশের কল্যাণ কামনায় একত্রে আল্লাহর দরবারে হাত তোলেন। হাসি মুখে একে অপরের সাথে করমর্দন ও কোলাকুলি করেন। একে অপরের খোঁজ-খবর নেন, দেখা সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। দেশজুড়ে পরিলক্ষিত হয় সৌভ্রাতৃত্ব ও সংহতির ঐকতান।

এসব বিবেচনায় মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এ সময়টা একটি লাকি মোমেন্ট হলেও সামগ্রিক বিবেচনায় দেশে এখন একটি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং মোমেন্ট চলছে, বলা যেতে পারে চরম এক ক্রান্তিকাল। দেশের সব অঙ্গনে বিরাজ করছে এক গুমোট পরিবেশ। বছর শেষে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠে চলছে অস্থিরতা। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতায় আসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ঘোরতর মতপার্থক্য বিরাজ করছে। আর এ সুযোগে বিশ্ব মোড়লরা সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমেছে সালিশি করার জন্য। কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির জন্য এটা মোটেই কোনো সুখকর বিষয় নয়। দুর্ভাগ্য আমাদের- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্ধ শতাধিক বছর পার হলেও জাতি হিসেবে আমরা এখনও নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নিজেরা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার মতো সাবালকত্ব অর্জন করতে পারিনি।

আরও একটি বিবেচনায় দেশ একটি সংকট কাল অতিক্রম করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর আমেরিকাকেন্দ্রিক যে এক-মেরু বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, হালে রাশিয়া ও চীন মিলে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি এবং পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার উচ্চাভিলাষ আমেরিকা ও তার মিত্রদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।

এ কারণে আমেরিকা ক্রমশ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি শক্তিশালী চীনবিরোধী বলয় গড়তে চাইছে, যেখানে সে চীনের প্রধান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও পাশে পেতে চায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশকে নিয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের মধ্যে টানাটানি চলে আসছে বরাবর। এভাবে বাংলাদেশ তার অবস্থানগত কারণে এসব আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং এদের প্রত্যেকে বাংলাদেশকে নিজ পক্ষভুক্ত করতে বা পক্ষে রাখতে এক রকম শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশের জন্য আঞ্চলিক ও বিশ্ব মোড়লদের এই টানাহ্যাচঁড়া যুগপৎ আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই হতে পারে। একদিকে, ঠিক মতো হ্যান্ডল করতে পারলে এদের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশকে নিয়মিত এদের পক্ষ থেকে নানাবিধ চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই এদের পারস্পরিক স্বার্থ সাংঘর্ষিক হওয়ায় এদের সাথে ডিল করতে গিয়ে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর এবং দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কৌশলে এদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে আসলেও এখন এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে একসাথে সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা কঠিন প্রমাণিত হতে পারে।

এহেন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সবার আগে যেটা দরকার সেটা হলো দৃঢ় জাতীয় ঐক্য। জনগণ যখন দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি জোগায়, তখন ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা– তা অভ্যন্তরীণই হোক কিংবা বৈদেশিক – অনেক সহজ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত জাতি আজ গভীরভাবে বিভক্ত। এ বিভক্তি যে কোনো মুহূর্তে ছাইচাপা আগুনের মতো বিস্ফোরিত হয়ে লংকাকাণ্ড ঘটিয়ে বসতে পারে। এ মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার একজন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তিত্বের, যিনি জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে বিবদমান পক্ষগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে আপস-মীমাংসার ব্যবস্থা করতে পারবেন।

মো. সাহাবুদ্দিন সবেমাত্র দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ঐতিহ্যগতভাবে এদেশে যে কোন দল নিজ দলের পরীক্ষিত ও নিবেদিত প্রাণ একজন সদস্যকেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। তথাপি, আইনগতভাবে, একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আর কোনো দলের থাকেন না, যদিও তার সর্বজনীনতার সাক্ষর কেবলমাত্র তিনিই তার দায়িত্বকালীন কার্যক্রম ও আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে রাখতে পারেন। এটি বহুলাংশে নির্ভর করে একজন ব্যক্তির সহজাত ব্যক্তিত্ব, ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব ও দীর্ঘদিনের আচরিত এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড ও কর্মপদ্ধতির ওপর।

যদিও সংবিধান অনুযায়ী এদেশে রাষ্ট্রপতির তেমন কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই, তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় সমাসীন এবং একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হন বিধায় অবস্থানগত কারণে তার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কাজেই, সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কেবল প্রয়োজন আন্তরিক সদিচ্ছা, ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতি এবং সতর্ক পদক্ষেপ। পৃথিবীতে কেউ নেতা হয়ে জন্মায় না, পরিবেশ ও পরিস্থিতি নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। মো. সাহাবুদ্দিন কি পারবেন জাতির এই সন্ধিক্ষণে সময়ের দাবি পূরণে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে?

সবাই ভালো থাকুন।

লেখক: অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসী বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/ফারুক/এমএস