রম্য
তোমার বউ কি কুইন এলিজাবেথের নাতি?
সকালবেলা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নাশতা করার অভ্যাস ওয়াসেক মোল্লার। আজও তাই করছিলেন। বিসমিল্লাহ বলে খাবারের প্লেটের দিকে হাত বাড়িয়ে পত্রিকার ভাঁজ খুললেন মোল্লা। খুলেই খাওয়ার কথা ভুলে গেলেন তিনি। পাশের চেয়ারে বসে নাশতা করছিলেন মোল্লার স্ত্রী বিলকিস বেগম। স্বামীকে এভাবে খাবার হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন-
: কী হইছে? খাবার সামনে লইয়া থুম ধইরা রইছেন কীজন্য?
: উঃ
: উঃ কী! নাস্তা করবেন না?
কিছু না বলে নাশতার টেবিল থেকে ওঠে পড়লেন মোল্লা। হাতের পত্রিকা ছুঁড়ে মারলেন মেঝেতে। সেইসঙ্গে উচ্চারণ করলেন কদর্য কিছু শব্দ। বিলকিস বেগম অবাক হলেন না। স্বামীর গালি বারোমাইস্যা বুলি-এটি তিনি বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেছেন। কাজেই গালি শুনে তার অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তিনি অবাক হলেন খাবার না খেয়ে মোল্লার ওঠে পড়া দেখে। এ বাসায় রান্না করার জন্য আলাদা লোক রয়েছে। তার হাতের রান্না খুবই ভালো। এদিক থেকে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। তাছাড়া একই খাবার তিনি নিজেও খাচ্ছেন। অতি চমৎকার রান্না। বিলকিস বেগম স্বামীকে বললেন-
: আপনের সমস্যা কী?
: কুনু সমস্যা নাই।
: তাহলে নাস্তা না কইরাই উঠে পড়লেন কীজন্য?
: সবকিছু তোমার সঙ্গে ডিসকাস করার প্রয়োজন মনে করি না। তুমি খাইতেছ, খাও। খাইয়া খাইয়া প্রতিদিন এক কেজি কইরা ওজন বাড়াও। তা না হইলে লোকজন বুঝবে কেমনে তুমি ভূমি অফিসের কর্মচারীর বউ।
ওয়াসেক মোল্লা পোশাক পরে অফিসে চলে এলেন। অফিস মানে ভূমি অফিস। মোল্লা এখানে ভালো দাপটের সঙ্গেই চলাফেরা করেন। চেয়ারে বসেই মোল্লা ফোন করলেন তার বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে-
: স্যার, আজকের পত্রিকা দেখছেন?
: উহু। এখনও দেখি নাই। কী হইছে!
: ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী তো স্যার ধরা খাইছে!
: কে ধরছে! দুর্নীতি দমন কমিশন?
: না, না। অই ধরা না। কাগজে-কলমে ধরা।
: বুঝলাম না।
: ইবলিশের বাচ্চা একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের জরিপের রেজাল্ট পাবলিশ করছে। ওই রেজাল্টে ওদের বাপদের অফিস মানে ভূমি অফিস এক নম্বর স্থান দখল করছে।
: গবেষণা প্রতিষ্ঠান যদি ইবলিশের বাচ্চা হয় আর ভূমি অফিসের লোকজন যদি হয় তার বাপ, তাহলে তোমার-আমার পরিচয় কী দাঁড়াইল? স্বয়ং ইবলিশ। তোমরা নিজেরাই যদি নিজেদের ইবলিশ বলে ঘোষণা করো, তাহলে অন্যের আর কী দোষ?
: বিষয়টা এত সুক্ষভাবে চিন্তা করি নাই স্যার। জোশের বশে বইল্যা ফেলছি।
: জোশ বলো আর ঘুস বলো, সবকিছুর মধ্যেই হুশ বজায় রাখবা।
: জি স্যার।
: গবেষণা প্রতিষ্ঠান কী বলছে?
: বলছে, দুর্নীতিতে আমরা এক নম্বর।
: কথা কি তারা মিথ্যা বলেছে? এই শহরে তুমি যে টাইলস ফিটিং কইরা তিনতলা বাড়ি খাঁড়া করছো, এইটা তো সত্য?
: বাড়ির মালিক তো আমি না স্যার; আমার বউ।
: তোমার বউ কি কুইন এলিজাবেথের নাতি? তার সম্পদের উৎস কী?
: স্যার! আমার কী আছে আর আপনের কী আছে, এইটা লইয়া ডিবেট করার জন্য আপনেরে ফোন করি নাই। ফোন করছি এই মুহূর্তে করণীয় কী, সেইটা ঠিক করার জন্য।
: কী করতে চাও?
: প্রথমে একটা বিবৃতি মারি-এইসব মিথ্যা। এরপর আমাদের চরিত্র হরণকারীদের বক্তব্যের স্বপক্ষে ডকুমেন্ট দাবি করি। তারপর একটা কমিটি গঠন করি। এই কমিটির একটা নামও আমি ঠিক কইরা ফেলছি স্যার। নাম দিছি ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার কমিটি।
: লাভ নাই। ভূমি অফিসের লোকজন যে ঘুস খায়, বাংলাদেশে এইটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
: এই সত্যের বিপরীতে আমরা কী কিছুই করি না? নিজেদের জীবন-যৌবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়া দিনরাইত মাঠপর্চা, নকশা, খতিয়ান ঘাইট্যা জমিজমার কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য আমরাই তো দৌড়াই! আমি সবচাইতে অবাক হইছি স্যার, পাবলিকের গাদ্দারি দেইখ্যা। মতামত জরিপে আমাদের বিরুদ্ধে এইরকম একটা নেগেটিভ মতামত দেওয়ার আগে অন্তত একবার চিন্তা করা উচিত ছিল, আমরা না থাকলে ওদের গাছতলায় যাইয়া দাঁড়াইতে হইত।
: বাদ দেও এইসব। শোন, মানুষ একবার ভালো বলবে, একবার মন্দ বলবে-এইটাই জগত-সংসারের নিয়ম। এইসব গায়ে না মাইখ্যা তোমার কর্ম তুমি কইরা যাও। আমি একটু বাইরে যাব। রাখি...
মানুষ বলে, দুঃখ ভাগ করলে কমে। কথাটা মনে হচ্ছে ঠিক না। ওয়াসেক মোল্লা দেখলেন, বসের সঙ্গে কথা বলে তার দুঃখভাব আরও প্রবল হয়েছে। মোল্লার সামনে একজন পিয়ন দাঁড়িয়েছিল। তাকে তিনি বললেন-
: ইমদাদ মিয়া।
: জি স্যার।
: ‘গু’ এক চামচ খাইলেও যে কথা; এক বালতি খাইলেও তো একই কথা?
: জি স্যার।
: আইজ থেইক্যাই বালতির ব্যবস্থা করতেছি।
: জি স্যার।
: খালি জি স্যার-জি স্যার কইরো না; কথাটা বুঝবার চেষ্টা করো; তুমি রোজা রাইখ্যা যদি এক ঢোক পানি খাও, তাহলে রোজার যেমন বদ্দিনাশ হইয়া যায়; তেমনি মোঘল-এ-আজম স্টাইলে খানাপিনা করলেও রেজাল্ট একই, ঠিক কিনা?
: ঠিক।
: তাহলে কোনটা ভালো?
: জি স্যার।
: ধুরু মিয়া! না বুইঝ্যা খালি জি স্যার-জি স্যার করতেছ। যাও, তোমার সঙ্গে কথা বইল্যা সুখ নাই।
কোনো কাজেই মন বসাতে না পেরে ঝিম মেরে বসে রইলেন ওয়াসেক মোল্লা। এসময় একজন লোক এসে তার সামনে একটা খাম রাখল। তিনি জানতে চাইলেন-
: কত আছে?
: পাঁচ।
: পাঁচে হবে না, পঁচিশ লাগবে।
: গতকাইল তো আপনের সঙ্গে ফাইনাল করলাম ভাই। আপনে নিজের মুখে বলছেন পাঁচ হাজারের কথা!
: গতকাইল কী বলছি,সেইটা ভুইল্যা যান। আইজ কী বলতেছি, সেইটা মনে রাখেন।
: ভাই! হঠাৎ চেইত্যা গেলেন কীজন্য?
: চেইত্যা গেছি একটা জরিপের রেজাল্ট দেখার পর। জরিপে পাবলিক আমাদের ‘এক নম্বর’-এর মর্যাদা দিছে। পাবলিকের দেওয়া মর্যাদা রক্ষা করা কি জরুরি কর্তব্য না, বলেন?
লোকটা আমতা আমতা করে বলল-
: তাতে বটেই।
: এইজন্যই আইজ থেইকা রেট পাঁচগুণ কইরা ফেললাম। বলেন, ঠিক করছি কিনা?
লেখক: কলামিস্ট, রম্যলেখক।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম