প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর এবং নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এটি পঞ্চম বারের মত জাপান সফর। তিনি ইতোপূর্বে ১৯৯৭, ২০১০, ২০১৪, ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাপান সফর করেছেন।
অতীতের যে কোন সফরের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বেশ কয়েকটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর হবে বলেই জানা গেছে। দুই দেশের সরকারপ্রধান প্রত্যাশা করছেন যে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে এবং এক অন্যান্য উচ্চতায় পৌঁছাবে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে এসংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরকে কেন্দ্র করে জাপান বাংলাদেশের সাথে তাদের দীর্ঘ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি কৌশলগত পর্যায় নিয়ে যেতে চায়। জাপানের এই চাওয়ার এক বিশেষ গুরুত্ব আছে। বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষকরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায় নিয়ে যাওয়া এক বিশেষ অর্থ বহন করে।
যখন দুদেশের সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায় চলে যায়, তখন আর সেই দেশের ভূমিকা শুধু আর্থিক বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সহযোগিতার ক্ষেত্র আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়িয়ে প্রযুক্তি স্থানান্তরসহ দেশের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে অংশীদারের পর্যায়ে চলে যায়।
জাপান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগীঃ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে জাপানের সহযোগিতা লিখে শেষ করা যাবে না। স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই জাপান আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রেখে আসছে। দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে আমাদের পথ চলায় জাপানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অবদান অবিস্মরণীয়। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে জাপানের সরাসরি সহযোগিতার যে যাত্রা বঙ্গবন্ধুর সময়ে শুরু হয়েছিল, তা বর্তমানে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে এসে সর্বোচ্চ পর্যায় উন্নীত হয়েছে।
এই দীর্ঘ পথচলায় প্রতিবছরই আমাদের দেশে জাপানী সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়ছে। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিগত পনের বছরের ধারাবাহিক শাসনামলে জাপানি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। এর বড় প্রমান বর্তমানে চলমান একাধিক মেগা প্রকল্পে জাপানি সহযোগিতার পরিমাণ। রাজধানী ঢাকায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল নির্মাণ করে তা চালু করার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে জাপানের সহযোগিতার পরিমাণ কত ব্যাপক।
এই প্রকল্পে জাপানের যে সরাসরি অংশগ্রহণ এবং কমিটমেন্ট তা বিশ্বে বিরল। হলি আর্টিজনে জঙ্গি হামলায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত সাতজন জাপানি প্রকৌশল দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করার পরও জাপান এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়নি। বরং তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রেখে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে করেছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তখন সেই অনুষ্ঠানে জাপানী রাষ্ট্রদূত এবং জাপানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদানকারী সংস্থা জাইকার কান্ট্রি প্রধান উপস্থিত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য প্রদান করেছেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত জাপানী দুই অতিথি স্পষ্ট করেই বাংলাদেশের সাথে জাপানের বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও জাপানের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও অটুট এবং বেগবান হবে।
অবকাঠামো নির্মাণে অব্যাহত সহযোগিতাঃ
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, যার সবগুলো বর্তমানে চলমান। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে দুতিনটির কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে আছে এবং আশা করা যায় আগামি এক বছরের মধ্যে এগুলো চালুও হয়ে যাবে। এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপানী সহযোগিতার কথা সর্বজনবিদিত। অত্যাধুনিক এবং খুবই উন্নত প্রযুক্তির এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপান যে শুধুমাত্র আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে চলেছে তাই নয়, সেইসাথে তারা প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও দিয়ে আসছে।
আগামীতে দেশে যেভাবে আরও নতুন নতুন মেগা প্রকল্প গ্রহণের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়, তাতে জাপানী সহযোগিতার পরিধি ও মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা শহরে অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে বিস্তর পাতাল রেল এবং মেট্রোরেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেছে, সেগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য জাপানি আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দেশে অবকাঠামো নির্মাণে জাপানি সহযোগিতার পাশাপাশি ভিন্ন ধরণের জাপানি বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনাও আছে।
জাপানি প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ সুবিধা নিয়ে দেশে স্মার্টফোন এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব এবং সে সকল কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে, বিশেষকরে পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে যে কি বিশাল অংকের জাপানি বিনিয়োগ হতে পারে তা অনেকের কল্পনার মধ্যেও নেই। একারণেই প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরকে কেন্দ্র করে এসব বিনিয়োগ সুবিধা ভালোভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
স্মার্টফোন উৎপাদন এবং বাজারজাত করার সুযোগঃ
বর্তমান বিশ্ব এখন স্মার্টফোন নির্ভর হয়ে গেছে। অনেক অত্যাবশ্যিক জিনিস, যেমন - বাড়ি, গাড়ি এবং এমনকি একবেলা খাবার না হলেও চলবে, কিন্তু স্মার্টফোন ছাড়া এক মুহূর্তও চলবে না। আজকাল আর আন্দোলন সংগ্রাম জমে উঠে না, এমনকি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থাতেও তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই, এর অন্যতম কারণ জনগণের কাছে স্মার্টফোন এবং ফেসবুক আছে।
আমার ধারণা যদি কোন কারণে স্মার্টফোন এবং ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে সরকারেরই পতন হয়ে গেছে। এই অবস্থা যে শুধু আমাদের দেশে তেমন নয়, সমগ্র বিশ্বে এই একই অবস্থা। কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মী লিফটে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকা ছিল। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাস করলাম যে তোমার ভয় করেনি, তখন সে অবলীলায় উত্তর দিল যে লিফটে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট এবং ফেসবুক দেখতে দেখতে সময় কেটে গেছে।
সুতরাং সমগ্র বিশ্বে স্মার্টফোন এখন অত্যাবশ্যিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃত এবং রয়েছে এর বিশাল বাজার। এমনকি আমাদের দেশেও রয়েছে প্রায় দশ কোটির অধিক স্মার্টফোনের বাজার। বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোনের এই বিশাল বাজার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুটো ব্র্যান্ড কোম্পানির উপর নির্ভরশীল, যার একটি হচ্ছে অ্যাপল এবং আরেকটি হচ্ছে স্যামসং।
ফলে স্মার্টফোনের বিশ্ব বাজারে তৃতীয় একাধিক স্মার্টফোনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। জাপানের স্মার্টফোন তৈরির উন্নত প্রযুক্তি থাকলেও স্মার্টফোনের বিশ্ব বাজারে তারা সেভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। কিন্তু তৃতীয় কোন দেশে স্বল্প বা প্রতিযোগিতাপূর্ণ মূল্যে স্মার্টফোন তৈরি করে তা খুব সহজে বিশ্বে বাজারজাত করার সুযোগ পেলে, জাপানি স্মার্টফোনও বিশ্ব বাজারে ভাল জায়গা করে নিতে পারবে। জাপানি বিনিয়োগের এই সুযোগ বাংলাদেশ নিতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরকে এই সুযোগ কাজে লাগানোর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন এবং রপ্তানির সুযোগঃ
পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা ভেবে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার এখন সকলের দাবি। বিশ্বে অনেক কোম্পানি বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন করে বাজারে ছেড়েও দিয়েছে। আমেরিকা-কানাডাতে তো বৈদ্যুতিক গাড়ি ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জাপান বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে অনেকদূর এগিয়ে থাকলেও তাদের উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ি এখনও সেভাবে বাজারে আসেনি। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে কোন নতুন প্রডাক্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠবে তখনই যখন সেই প্রডাক্ট আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করা হবে।
আবার আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো তাদের নিজের দেশের কম্পানির উৎপাদিত পণ্য সেভাবে বাজারজাত না করা পর্যন্ত বিদেশি কম্পানির উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করার অনুমতি দিতে চায়না। এসব কারণে আপাদত জাপানি বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে না এলেও, তারা প্রস্তুত হয়েই আছে এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র বিশ্ব বাজার জাপানি বৈদ্যুতিক গাড়িতে সয়লাব হয়ে যাবে।
পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিশাল বাজার আছে, যা ধরার জন্য জাপানি গাড়ি উৎপাদনকারী কোম্পানি প্রস্তুত হয়েই আছে। কিন্তু তাদের এমন একটি দেশ প্রয়োজন যেখানে তারা স্বল্প মূল্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপন্ন করে খুব সহজে সেসব দেশে রপ্তানি করতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে জাপানি বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের উপযুক্ত স্থান।
তাছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং আগামিতেও হবে, বিশেষকরে সমগ্র দেশ যেভাবে উন্নত সড়ক যোগাযোগের আওতায় চলে এসেছে, তাতে বাংলাদেশেই রয়েছে এক কোটির উপরে গাড়ির বাজার, যা আগামিতে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। একারণেই বাংলাদেশ জাপানের এই বিনিয়োগ সুবিধা কাজে লাগাতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করেই এই বিনিয়োগ গ্রহণের চেষ্টা শুরু করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপানের সহযোগিতার পাশাপাশি আমাদের দেশে যে জাপানের অনেক নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী যারা থাকছেন, বিশেষ করে যে ব্যাবসায়িক প্রতিনিধি দল সফরসঙ্গী হয়েছেন, তাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রধানমন্ত্রীর সফরেই বিনিয়োগ সুবিধা চূড়ান্ত হয়ে যাবে না। এই সফরে জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার সূচনা হতে পারে মাত্র। আর এই আলোচনার সূত্র ধরে দেশে জাপানি বিনিয়োগের জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। একাজে জাপানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এবং আমাদের ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের ক্রমাগত ভূমিকা রাখার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
অতীতে অনেক দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরে কিছু সুযোগ সৃষ্টি হলেও, সেগুলো পরবর্তীতে ফলো-আপ পদক্ষেপের অভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে যে বিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে বলা প্রত্যাশা করা যায়, তা যেন সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি সেই প্রচেষ্টা প্রথম থেকেই থাকা প্রয়োজন।
লেখক: সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম