আমাদের সব আছে নেই শুধু মানবিক মূল্যবোধ!
কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র গরম আর তাপদাহে মানুষের জীবন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার উপক্রম। এর মধ্যে রমজানের আগেই দ্রব্যমূল্য নিয়ে নাভিশ্বাস, আর রাজধানীর কয়েকটি বিখ্যাত মার্কেটে আগুনে পোড়ার ঘটনা, পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রা তার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাণের টানে ঈদযাত্রা যেন মানুষের মনে আরও প্রশ্ন কীভাবে আমাদের এই ক্লান্তির পথ দূর হবে আর কবে? সবার মনেই প্রশ্ন কি আছে কি নেই?
এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (চৈতালি) কবিতার কথা মনে আসে-
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,…
পৃথিবীর মানুষ আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। আমরাও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলেছি। গত তিন বছর আগে মার্চের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর। সে সময়ে তীব্র দাহনে নাভিশ্বাস। ভেবেছিলাম আমি এক সপ্তাহের জন্য এসেছি ওরা কীভাবে সারাবছর এ গরমের তীব্রতা নিয়ে বাঁচে।
পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমাদের এক প্ল্যাকার্ড কন্যা সবার গোচরে নিজকে নিয়ে এসেছেন। শ্যামলা সুন্দরী, গায়ে গতরেও আকর্ষণীয়, সাজগোজ বেশ তার একমাত্র বক্তব্য-
‘চাল জোটে না ইলিশ কই পাবো?’
বাংলাদেশের মানুষের চালের অভাব, ভাতের অভাব, বাংলার মানুষ না খেয়ে মরছে? ভাইরাল হওয়ার জন্য কত কিছুই না মানুষ করে? শোন মেয়ে তোমার সাজ পোশাক, বাইকে করে বেড়িয়ে যাওয়া দেখেই বোঝা যায় তুমি খোঁপায় ফুল গোঁজা এজেন্ট। তবে কার এজেন্ট তা বোঝার ক্ষমতা সবার আছে।
আমার দেশ বাংলাদেশ। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা, শ্যাম কুন্তলা, সাগর মেঘলা, পাহাড়, গিরি নদীর দেশ আমার এই বাংলাদেশ। কি নেই আমার এই সোনার বাংলায়? আমার সোনার দেশে সোনার মানুষেরা আছে, বাংলাদেশের মতো এতো সস্তায় শ্রমবাজার পৃথিবীর কোথাও নেই। দেশের কৃষক ক্লান্তিহীন দিনরাত পরিশ্রম করে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে ফসল ফলায় আমাদের চাহিদা মিটায়। সেদিন নরসিংদী বেড়াতে গেলাম দেখলাম ঢাকা শহরের অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে তরকারি ফলফলাদি।
আমাদের সাগর, নদী, খাল, বিল ঝিলে আছে হাজারো প্রজাতির, হাজারো স্বাদের মিঠা পানির, লবণ পানির সুস্বাদু মাছ, আছে পুকুরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা মাছ। ইলিশ তো উৎপাদন করতে পারে না যদি সম্ভব হয় খাবে ইলিশ। আমাদের আছে পোল্ট্রি শিল্প এতো কম দামে মুরগি, হাস, কবুতর, ডিম কোথাও পাওয়া যায় কি না জানি না। আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডেইরি ফার্মগুলো থেকে উৎপাদিত গরু, ছাগল, মহিষের খাঁটি দুধ, এদের মাংস আমাদের চাহিদা পূরণ করেই চলেছে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ঋতুতে সুস্বাদু সবজি ফলে। পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন তাজা সুস্বাদু সবজি পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। বাজারে কি নেই বলেন তো।
ঋতু ভেদে ফুল ফসলের পসরা সাজিয়ে বসে আমার দেশের প্রকৃতি, সাজে অনন্য সাজে, ফুল ফসলে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, কমলা, বেল, আনারস, করমচা, ড্রাগন ফল, তরমুজ, বাঙ্গি, লটকন, আতাফল, শরিফা একেক ফলের একেক স্বাদ অপূর্ব।
ফুল চাষীরা উৎপাদন করে গোলাপ, জবা, টগর, বেলী, জুঁই, যুথি, কামিনী, লিলি, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ আরও কতো নাম জানা অজানা ফুল। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে কত রকমের, কতো ধরনের কতো প্রকারের সাদা, লাল, চিকন, মোটা ধান উৎপাদিত হয়, বিভিন্ন জাতের ডাল মুগ, মসুর, ছোলা উৎপাদন করে চাষীরা, আছে পেঁয়াজ, রসুন, লবণ, আদা, হলুদ, মরিচ, আছে সরিষা, তিল, চিনি, নারকেল তেল।
সব আছে সব আমাদের আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ অনন্য। দেশের চাহিদা পূরণ করে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকের প্রশংসায় জয়জয়কার। ঔষধ শিল্পে বাংলাদেশ আজ স্বনির্ভর। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ সামগ্রিক দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
আমাদের সব আছে, সবই আছে নেই শুধু সততা, নেই ন্যায়পরায়ণতা, নেই মানবিক মূল্যবোধ। আছে লোভ, লালসা, কি চাই, আর কি পাইনি শুধু খাই আর চাই। রোজা এলে ব্যবসায়ীদের জিহ্বায় লালা ঝরে কীভাবে প্রতারণা করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা যায়। নীতিনৈতিকতা কিছুই নেই। স্বীকার করতেই হবে এখান আছে সমন্বয়হীনতা, আছে সুযোগ পেলেই চুরি করার প্রবণতা, যে যেভাবেই সুযোগ পাবে লুটে পুটে খাওয়ার এক জঘন্য মানসিকতা।
দুর্যোগের সময় যেখানে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে সেখানে কোনো মানসিকতায় ত্রাণের চাল, ডাল, চিনি, তৈল চুরি করে। চোরের সংখ্যা বেশি নয়, এক বালতি দুধে এক ফোঁটা মূত্রে যেমন সব ধ্বংস করে দেয় তেমন এ নাদানেরা। ওদের পেট বিশাল আকৃতির, ওদের লজ্জা নেই, ওদের মানসন্মান নেই, এরা তো ছিঁচকে চোর, আরও আছে মহা চোর, রাঘব বোয়ালরা। যাদের নেই দেশপ্রেম, নেই মানবপ্রেম, নেই প্রকৃতিপ্রেম। নির্লজ্জ, বেহায়া এরা। একজন প্রধানমন্ত্রী কতো দিকে তাকাবেন তিনি। দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ওনার সব অর্জন এভাবে নষ্ট করার অধিকার কারও নেই।
প্রয়োজন মাদকবিরোধী অভিযানের ন্যায় কৌশল। এদের বিরুদ্ধে চিরুণী অভিযান চালানো উচিত। আমাদের মানুষ আছে! অনেক মানুষ! ঘরে মানুষ! রাস্তায় মানুষ! হাটবাজারে মানুষ! মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় মানুষ! হাসপাতালে মানুষ! স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসায় মানুষ! কোর্ট কাচারিতে, অফিস-আদালতে মানুষ! খেলার মাঠে মানুষ, বিনোদন পার্কে মানুষ! অভাব নেই, জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি থামানোর ব্যবস্থা নেই।
আছে অনেক অনেক ষোল কোটি, এছাড়া আমাদের চাষের জমি আছে জনবল আছে, কৃষক আছে, জেলে আছে শ্রমিক আছে, নির্মাণশিল্পী আছে, গার্মেন্টসকর্মী আছে- আছে মনোবল। আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের অধীনে উৎপাদিত সামগ্রী যদি বিপণনের ব্যবস্থা করে তাহলে ফুল, ফসল, মাছ, কোনো কিছুর উৎপাদন বন্ধ হবে না, ঘাটতি থাকবে না, ন্যায্যমূল্য পেলে প্রান্তিক উৎপাদনকারীরা বিমুখ হবে না।
স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করে তাদের উৎসাহিত করতে হবে, সরকারি প্রণোদনা দিয়ে অধুনা আগুনে পুড়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নিজেদের দেশে কিছুই উৎপাদন করতে পারে না, অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা তা নই।
একটাই প্রার্থনা আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা অনেক অন্যায় করেছি উৎপাদনের ধানীও ফসলের জমি কেটে বসতি স্থাপন করছি, নব সভ্যতার সূচনা করেছি। বন পুড়িয়ে, বৃক্ষ কেটে বন উজার করেছি, সব সাবার করেছি। পাহাড় কেটেছি, পানিতে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে দূষিত করেছি, ইটভাটা করে বায়ুদূষণ করেছি, পানিদূষণ, প্রকৃতি দূষণ কিছুই বাদ রাখিনি।
ঈদ আসছে, ঈদ আছে, ঈদ থাকবে। জীবন বাজি রেখে এ গরমে সড়কপথ, রেলপথ, নৌপথের তীব্র যানজটে চিন্তা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আনন্দের জায়গায় মরণ হাতছানি দিয়ে ডাকছে না তো?
রেলপথে দুর্ঘটনা দেখেছি। সবাই সাবধানতা অবলম্বন করি।
জীবন একটাই, পৃথিবীতে দুবার আসার সুযোগ নেই। আমাদের শপথ হোক আমরা দুর্নীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত, জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়বো এ হোক আমাদের অঙ্গীকার। আল্লাহ সহায় হোন।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম