সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক
আগামী নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহলের শেষ নেই। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দেশে ফিরে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেনি যুক্তরাষ্ট্র। তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটাও বলেছেন যে, বিদেশিদের কাছে নালিশ জানিয়ে লাভ হবে না। কিন্তু বিএনপি নালিশের পথেই হাঁটছে।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে রোববার বৈঠক করেছেন বিএনপির নেতারা। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমেরিকার মাথা ব্যথা না থাকলেও বিএনপি কিন্তু দলনিরপেক্ষ সরকারের অবস্থান থেকে সরছে না। আবার সরকারও সংবিধানের বাইরে যাবে না। তাহলে আসলে কেমন পরিস্থিতি দাঁড়াবে আগামী নির্বাচন ঘিরে- এ প্রশ্ন এখন রাজনীতি সচেতন সব মানুষের মনেই।
এদিকে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সকলের সহায়তা করা উচিত।’
গত ৭ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে সংসদে দেওয়া তার শেষ ভাষণে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে। দেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে যায়। আবার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নকে স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে।’
একজন পুরোনো রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বক্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন সহিষ্ণুতার বড়ই অভাব। কেউ কাউকে সহ্য করতে চায় না। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার বদলের পথে না হেঁটে শুধু আন্দোলন আন্দোলন জিগির তুলে একটি উত্তেজনাকর অবস্থা তৈরি করে রাখাই যেন অনেকের কাছে গণতন্ত্র বলে মনে হচ্ছে। যে সব দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার লেশমাত্র নেই, সেসব দলের নেতাদের মুখে গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার হাস্যকর মনে হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে বিদ্বেষ-বিরূপতা কমবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে তেমন লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গরম হাওয়া। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কথার বোমশেল নিক্ষেপ করে চলেছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক এটা যদি আওয়ামী লীগ আন্তরিকভাবে চায়, তাহলে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির ওপর হামলা-মামলা কম হওয়াটাই প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে ঘটছে তার বিপরীত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তব ঘটনাবলি দেখে মনে হচ্ছে, সরকার বিএনপির প্রতি এখনো নমনীয় অবস্থানে আসেনি। এর কারণ কি?
কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপি নেতারা সরকার পতনের হুমকি-ধমকি অব্যাহত রাখলে আওয়ামী লীগও তাদের ছাড় দেবে না। আর বিএনপি নেতারা উসকানিমূলক কথা কম বললে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়া অব্যাহত থাকলে বিএনপির কর্মসূচিকেই সহজভাবে নেবে না ক্ষমতাসীন দল।
মাস কয়েক আগে বিএনপি ও ছাত্রদলের ওপর হামলার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গণমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে সম্প্রতি তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এবং উন্নয়নবিরোধী যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে, তাতে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সুতরাং বিএনপি শান্তিপূর্ণ থাকলে আওয়ামী লীগ অশান্তি সৃষ্টি করতে যাবে কেন?
অন্যদিকে, ছাত্রদলের ওপর হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ইদানীং ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ভাঙচুর থেকে শুরু করে অছাত্র-বহিরাগতদের নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার অপকৌশল নিয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্রদলকে প্রতিহত করেছে। এখন থেকে সহিংসতার উদ্দেশ্যে ছাত্রদল যখনই ক্যাম্পাসে আসবে, তখনই তাদের প্রতিহত করা হবে।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি ও ছাত্রদলকে চলতে হবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের এঁকে দেওয়া ‘শান্তিসীমানার’ মধ্যে। এটা কি সম্ভব? বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নিজেদের ভুল ও ব্যর্থতার কারণে ক্ষমতার বাইরেও আছে বহু বছর ধরে। বিএনপির এখন অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা। তারা এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় দুটো। হয় নির্বাচনে জিততে হবে অথবা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি জিততে পারবে বলে তারা মনে করে না। তাদের ধারণা মানুষ ভোট দিলেও তাদের হারিয়ে দেওয়া হবে কারসাজি করে। তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হঠানোর কোনো বিকল্প বিএনপির সামনে নেই। কিন্তু বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারছে না। এই অবস্থায় কি করবে বিএনপি?
কেউ কেউ মনে করেন, দেশ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থেই বিএনপির উচিত কিছু সময়ের জন্য হলেও সরকারের নিয়ন্ত্রিত পথেই হাঁটা। বড় বড় হুংকার না দিয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষকে সংগঠিত করা, তাদের আস্থায় আনা। কিন্তু বিএনপি সেটা সন্মানজনক বলে মনে করছে না। তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নীতিতে নয়, সংঘাতের নীতিতেই এগোতে চায়।
বিএনপির মারমুখী হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে এটা সামনে এসেছিল যে, গত বছর ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অতীতে দেওয়া বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে একপর্যায়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে। সেতুতে যে স্প্যানগুলো বসাচ্ছে, এগুলো তার কাছে ছিল জোড়াতালি দেওয়া। বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে কিছু দোসররাও এমন বলেছিল। তাদের এখন কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দেওয়া উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি।
নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে বিএনপি। রাজপথের আন্দোলন বেগবান করার রূপরেখা তৈরিতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু করেছে। নানা ধরনের দফা তৈরি করা হচ্ছে। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি একটার পর একটা দিয়েই চলেছে। বিএনপি মনে করছে, যেভাবেই হোক দীর্ঘদিন পরে তাদের আন্দোলনে গতি এসেছে, জনসমর্থনও বেড়েছে। আন্দোলনের এই গতিকে তারা ধরে রাখবে। এখান থেকেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা চলছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য: সরকারের দমন-পীড়নে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। অন্যদিকে জিনিসপত্রের লাগামহীন দামসহ নানা কারণে দেশের মানুষও অতিষ্ঠ। এই প্রেক্ষাপটে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বর্তমানে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা হবে। মামলা-হামলা দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন দমানো যাবে না বলে তাদের বিশ্বাস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং এটা চলবে। সমমনা দলগুলো বিএনপির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। বিএনপি বড় দল হিসেবে চেষ্টা করছে, আন্দোলন যে গতি পেয়েছে, সেটাকে অব্যাহত রাখতে। ধরপাকড়, মামলা-মোকদ্দমায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নেতাকর্মীরা এ নিয়ে আর কিছু মনে করে না।’
বিএনপি নেতা চলমান সংঘাতকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে মনে করছেন। সারা দেশের মানুষ এখন নানা কারণে নিষ্পেষিত, দেশে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেই অস্থিরতার জায়গা থেকে যেকোনো সময় মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করছেন।
‘মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে’ বলে বিএনপি নেতাদের যে আশা তার কোনো লক্ষণ কি মাঠে দেখা যাচ্ছে? সরকারের কিছু কিছু কাজে মানুষ অসন্তষ্ট হলেও বিএনপির প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ নেই। আবার নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও কোনো নতুন চিন্তার কথা শোনা যায় না। এ অবস্থায় ‘দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর’ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির জন্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত করার যে পরামর্শ রাষ্ট্রপতি দিয়েছেন তা কি রাজনৈতিক দলগুলো বিবেচনায় নেবে? সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম