মাহে রমজান
প্রকৃত রোজা যে শিক্ষা দেয়
আজ সোমবার, পবিত্র মাহে রমজানের মাগফিরাতের দশকের ৮ম দিনের রোজা রাখার সৌভাগ্য আমরা লাভ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। রোজা এমন একটি বিষয় যা সকল ধর্মেই গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে উপবাস প্রথা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে। তবে সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ ধর্ম ইসলামে এর ধরনটা একটু ভিন্ন।
ইসলামের মূল উৎস কুরআন করিম। এতে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।
উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কেবল ইসলামের সাথেই রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং কুরআন করিম অবতীর্ণ হওয়ার পূববর্তী মাজহাবগুলোতেও রোজাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ভারতবর্ষকে ধর্ম বিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে দাবি করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বর্ত বা ব্রত অর্থাৎ রোজা থেকে এখানকার ধর্মগুলোও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রতিমাসের ১১ ও ১২ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশীয় রোজা অপরিহার্য ছিল। এই হিসেব অনুসারে বার মাসে সর্বমোট ২৪টি রোজা পাওয়া যায়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবারে রোজা ব্রত পালন করে।
হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে অর্থাৎ তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে উপোস থাকার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের সকল ধর্মমতে বিশেষ করে জৈন ধর্মের মাঝে রোজা পালনের শর্তাবলী অত্যন্ত কঠিন। তাদের মতানুসারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত একটি রোজা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে প্রতি বছর জৈন ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবৎ রোজা ব্রত পালন করে।
প্রাচীন মিশরীয়দের মঝেও রোজাকে অন্যান্য ধমীর্য় অনুষ্ঠানাদির অন্তভুর্ক্ত দেখা যায়। গ্রীক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা ‘থাসমো ফেরিয়া-এর তৃতীয় তারিখে রোজা রাখতো। পার্শিয়ান ধর্মে যদিও সাধারণ অনুসারীদের ওপর রোজা ফরজ নয় কিন্তু তাদের ইলহামি কিতাবের একটি শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের ওপর রোজার হুকুম প্রযোজ্য ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাদের জন্য পাঁচ বছর রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : ১০ম খণ্ড, ১৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, একাদাশ সংস্করণ)
ইহুদীদের মাঝেও রোজা ছিল আল্লাহ আরোপিত ফরজ ইবাদত। হজরত মূসা (আ.) কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎপিপাসার ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন (নির্গমনঃ ৩৪-৩৮)। সুতরাং সাধারণভাবে হজরত মূসা (আ.)এর অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ রোজা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তাদের ওপর চল্লিশতম দিনে রোজা রাখা ফরজ বা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। (তৌরাতঃ সফরুল আহবার: ১৬-২৯-৩৪ : ২৩-২৭) খৃস্টান ধর্মে বর্তমান কালেও রোজার প্রভাব বিদ্যমান। হজরত ঈসা (আ.)ও চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোজা রেখেছেন (মথি: ৪-২)। হজরত ইয়াহইয়া (আ.) যিনি হজরত ঈসা (আ.)এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোজা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোজা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্কস: ২-১৮)
এছাড়া রোজা যে আত্মাকে পবিত্র করে এ সম্পর্কে মথিতে উল্লেখ আছে, এক স্থানে হজরত ঈসা (আ.)এর নিকট তার অনুসারীরা জিজ্ঞেস করলো যে আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তর সমূহকে কিভাবে দূর করে দিতে সক্ষম হবো? প্রত্যুত্তরে হজরত ঈসা (আ.) বললেন, অন্তর সমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে দোয়া এবং রোজা ছাড়া দূর করার কোন ব্যবস্থা নেই (মথি: ১৭-২১)।
আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কমবেশী ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখতো যে, এই দিনে খানা কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৪) উপরোক্ত বিশ্লেষণের দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, কুরআন করিমের সুরা বাকারার ১৮৩ আয়াতটি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ইসলাম ধর্মে এই উপবাস ব্রতের মধ্যে নবরূপ ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রকৃত রোজা পালন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় আমরা যেন সব ধরনের পাপ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখি।
আমাদের প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং এর ওপর আমল করা থেকে বিরত থাকেনা আল্লাহতায়ালার জন্য তার উপবাস থাকা এবং পিপাসার্ত থাকার কোন প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তার রোজা রাখা বেকার বলে গণ্য হবে’ (বুখারি, কিতাবুস সওম)।
অর্থাৎ মানুষ যখন রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে গাফেল হয়ে যায় তখন সে শুধু নিজেকে উপবাসই রাখে যা আল্লাহতায়ালার জন্য কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কোন নিয়তে সে রোজা রাখছে এটাই মূল বিষয়।
হজরত ফাতেমা যাহরা (রা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি নিজের জিহবা, চোখ, কানসহ অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সংযত করতে পারে না তার রোজা কোনো কাজেই আসবে না’ (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৩, পৃষ্ঠা ২৯৫)।
একজন ব্যক্তির কেবলমাত্র অভুক্ত আর পিপাসার্ত থাকাই রোজার মুল উদ্দেশ্য নয়। কেননা মহানবি (সা.) বলেছেন: ‘তোমাদের কেউ যখন কোনদিন রোজা রাখে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং গোলমাল ও ঝগড়াঝাটি না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা কেউ তার সাথে ঝগড়াঝাটি করে তবে তার বলা উচিত, ‘আমি রোজাদার’ (বুখারি)।
তিনি (সা.) অপর এক স্থানে বলেন, ‘যে ব্যক্তি রোজাদার আর সে যদি চুপ থাকে তাহলে সেটাও তার জন্য ইবাদত, তার ঘুমও ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হবে। তার দোয়া গ্রহণীয় হবে। আর তার আমলের প্রতিদান বাড়িয়ে দেয়া হবে’।
মহানবী (সা.) আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যারা রমজান মাসে প্রবেশ করেছে এবং আন্তরিকতার সাথে রোজা রাখছে তাদের চেহারায় এক পবিত্র পরিবর্তন দেখা যায়, তাদের আত্মা নূরানী হয়ে যায় এবং তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। আর শয়তানকেও শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি রমজান থেকে কল্যাণ না উঠিয়ে কেবল সেহরি আর ইফতার করে তার জন্য এই রোজা কোনো কাজের নয়।
ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। তাই ইসলামেই রোজাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করে একে পালনের জন্য ফরজ করা হয়েছে এবং এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র মাহে রমজানের রোজার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বেশি বেশি পুণ্যকর্ম করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম