চীনের পঞ্চম সৌরপদ ও সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ উৎসব
চীনে উৎসবের কমতি নেই। জাতীয় উৎসব যেমন আছে অনেক, তেমনি ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতির নিজস্ব উৎসবও আছে এন্তার। তবে, জাতীয়ভাবে চীনে বছরে মূলত চারটি উৎসব পালিত হয়: বসন্ত উৎসব, ড্রাগন নৌকা উৎসব, মধ্য-শরত উৎসব, এবং ছিংমিং চিয়ে বা সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ উৎসব।
এর মধ্যে ছিংমিং-কে ঠিক ‘চিয়ে’ বা উৎসব বলতে নারাজ অনেক চীনা। কেন নারাজ, সেটা এর বাংলা নাম দেখেই পাঠক আন্দাজ করতে পারেন। স্বজনদের কবর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দিনটাকে ঠিক আনন্দের বলা মুশকিল। কিন্তু, আধুনিক যুগে এসে এই ‘দুঃখের’ দিনেও, চীনারা আনন্দ খুঁজে পেতে শিখেছে। তাই আজকাল একে উৎসব হিসেবেই গণ্য করা হয়।
ঘটনাক্রমে, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার পঞ্চম সৌরপদের নামও ‘ছিংমিং’ এবং এই সৌরপদের প্রথম দিনেই পালিত হয় সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ উৎসব। তো, এই সৌরপদের রীতিনীতি নিয়ে কথা বলার আগে খোদ সৌরপদ কী, তা একটু জেনে নেওয়া যাক। চীনের সৌরপদ নিয়ে আলোচনায় আমি প্রায় বলতে গেলে সবসময়ই এই কথাগুলো বলে থাকি। যারা আগেই পড়েছেন, তাদের স্মৃতি এতে ঝালাই হবে; আর যারা পড়েননি, তাদের পড়া হবে, জানা হবে।
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই ২৪টি সৌরপদ বা সোলার টার্ম হচ্ছে: লি ছুন (বসন্তের শুরু), ইয়ুশুই (বৃষ্টির পানি), চিংচ্য (পোকামাকড়ের জাগরণ), ছুনফেন (বসন্ত বিষুব), ছিংমিং (তাজা সবুজ), কুইয়ু (শস্য-বৃষ্টি), লিসিয়া (গ্রীষ্মের শুরু), সিয়াওমান (কম পূর্ণতা), মাংচুং (ফসল বোনার সময়), সিয়াচি (উত্তরায়ন), সিয়াওশু (কম গরম), তাশু (বেশি গরম), লিছিয়ু (শরতের শুরু), ছুশু (গরমের শেষ), পাইলু (শুভ্র শিশির), ছিউফ্যন (শারদীয় বিষুব), হানলু (ঠাণ্ডা শিশির), শুয়াংচিয়াং (প্রথম হিমেল হাওয়া), লিতুং (শীতের শুরু), সিয়াওসুয়ে (ছোট তুষার), তাসুয়ে (বড় তুষার), তুংচি (দক্ষিণায়ন), সিয়াওহান (ছোট শীত), তাহান (বড় শীত)।
প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে— তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে।
এখন চলছে সৌরপদ ছিংমিং। চীনা ভাষায় ‘ছিং’ মানে ‘পরিষ্কার’ বা ‘স্বচ্ছ’ বা ’সাফ’বা ’বিশুদ্ধ’ বা ’স্পষ্ট’; আর ‘মিং’ মানে হচ্ছে ‘উজ্জ্বল’ বা ’শুভ্র’ বা ’সুন্দর’ বা ’দীপ্ত’। ‘ছিংমিং’-কে ইংরেজি করা হয়েছে Clear & Bright। বাংলায় বলা যেতে পারে ‘তাজা সবুজ’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চীনে আসার পর থেকেই ‘ছিংমিং চিয়ে’ টার্মটার বাংলা শুনে আসছি ‘সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ উৎসব’। যা হোক, এ বছর চীনের পঞ্চম সৌরপদ ছিংমিং-য়ের শুরু ৫ এপ্রিল এবং শেষ ২০ এপ্রিল।
নাম দেখেই বোঝা যায়, এই সৌরপদে আবহাওয়া থাকে চমৎকার; পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উজ্জ্বল প্রতিভাত হয়। এ সময় শীতের আমেজ কেটে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে; বৃষ্টিপাতও কমবেশি বাড়ে। বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষিকাজের জন্য সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।
যেমনটি আগেই বলেছি, পঞ্চম সৌরপদের প্রথম দিনটি সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ দিবস। এ সময় চীনারা প্রকৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে; শ্রদ্ধা নিবেদন করে পূর্বপুরুষদের প্রতি। প্রাচীনকাল থেকেই এই রীতি চলে আসছে। এদিন চীনারা পূর্বপুরুষদের সমাধি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। সমাধি পরিষ্কার করার সময় আশেপাশের আগাছা তুলে ফেলা হয়, সমাধিতে নতুন মাটি ফেলা হয়, এবং কেউ কেউ সমাধিতে নতুন গাছ লাগায়। সমাধিতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যও নৈবেদ্য হিসেবে রাখা হয়।
খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে থাকে মৃত ব্যক্তির প্রিয় খাবার, পানীয়, ও চপস্টিক। আরও থাকে নকল টাকা, যাকে বলা হয় স্পিরিট মানি বা পেপার মানি। স্পিরিট মানি আগুনে পোড়ানো হয়। প্রাচীনকাল থেকে চীনাদের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, এভাবে নকল টাকা পোড়ালে, অন্য জগতে মৃত ব্যক্তির খাদ্য বা অর্থের অভাব হবে না।
প্রাচীন কাল থেকেই চীনারা এটা বিশ্বাস করে আসছে যে, ছিংমিং সৌরপদে ভূতের আনাগোনা বেড়ে যায়; এ সব অশুভ ভূত জীবিত মানুষের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এদের বা এদের খারাপ প্রভাব থেকে বাঁচতে এসময় উইলো গাছের ডালপালা ব্যবহার করা হয়।
বৌদ্ধদের বিশ্বাস অনুসারে, উইলো গাছের ডালপালা অশুভ আত্মা বা ভূত-প্রেত দূরে রাখে। তাই, উইলো গাছকে ‘ভূতের জম’ বলে ডাকা হয়। প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, যদি ছিংমিং সৌরপদে কোনো তরুণী শরীরে উইলো গাছের ডালপালার অংশবিশেষ ধারণ না করে, তবে সে দ্রুত বুড়িয়ে যাবে। আরেক বিশ্বাস অনুসারে, এই সৌরপদে উইলো গাছে ডাল ও পাতা শরীরে ধারণ না করলে, মৃত্যুর পর সে হলুদ কুকুর হয়ে পুনরায় জন্ম নেবে।
বলছিলাম, আধুনিক কালে এসে ছিংমিং উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটা সত্য যে, প্রিয়জনের সমাধি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও তাদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিবেদন করার সময়টা মানুষের মন খারাপ থাকে। কিন্তু, একটা ভালো কাজ করার ভালো অনুভূতিও তখন কাজ করে। সেই ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে তখন অনেক চীনা সুন্দর প্রকৃতিকে উপভোগ করতে সুন্দর কোনো জায়গায় চলে যায় পরিবার-পরিজন নিয়ে।
প্রকৃতি এ সময় শীতের প্রভাব কাটিয়ে সবুজ হয়ে ওঠে, চারিদিকে নানান ধরনের ফুল ফোটে, সূর্যালোকে চারিদিক চকচক করতে থাকে; আশেপাশের সবকিছুই যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার এ এক অনন্য সময়। চীনারা সাধারণত এ সুযোগ হাত ছাড়া করে না।
চীনারা ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করে। ছিংমিং সৌরপদে বিশেষভাবে তারা ঘুড়ি ওড়ায়। শুধু দিনের বেলায় নয়, রাতের বেলায়ও তারা ঘুড়ি ওড়ায়। রাতের ঘুড়ির সঙ্গে ছোট ছোট বাতি জুড়ে দেওয়া হয়। ঘুড়ি যখন আকাশে ওড়ে, তখন সেগুলোকে উজ্জ্বল তারার মতো লাগে। রাতে ঘুড়ি ওড়ানোশেষে ঘুড়ির সুতো কেটে দেওয়া হয়। প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, মুক্ত ঘুড়ি মানুষের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে ও রোগ-বালাই সঙ্গে নিয়ে যায়।
ছিংমিং চিয়ে বা সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ উৎসবের আগের দিন পালিত হয় ঠাণ্ডা খাবার উৎসব। চীনা ভাষায় একে ডাকা হয় ‘হানশি’ উত্সব। এদিন চুলায় আগুন জ্বালানোকে অশুভ মনে করা হয়। এ সময় ঠাণ্ডা খাবার খাওয়ার নিয়ম। এই উৎসবের পেছনেও আছে একটি কিংবদন্তি। কথিত আছে, প্রাচীন চিন রাজ্যের রাজকুমার ছোং’য়ের (Chong’er) নির্বাসনে থাকাকালে ভীষণ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন। রাজকুমারের প্রচণ্ড ক্ষুধা দূর করতে তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচর চিয়ে জিথুই (Jie Zitui) নিজের উরু থেকে মাংস কেটে নিয়ে রাজকুমারকে খেতে দেন।
কিন্তু নিজের রাজ্য ফিরে পাওয়ার পর রাজকুমার চিয়ে জিথুইকে পুরস্কৃত করার পরিবর্তে আগুনে পুড়িয়ে মারেন। পরে রাজকুমার নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত হন এবং এই মর্মে আদেশ জারি করেন যে, চিয়ে জিথুইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে কেউ গরম খাবার খেতে পারবে না, ঘরে চুলা জ্বালাতে পারবে না; সবাইকে ঠাণ্ডা খাবার খেতে হবে। সেই থেকে এই ঠাণ্ডা খাবার খাওয়ার রীতি চলে আসছে।
ঠাণ্ডা খাবার উৎসব চলাকালে চীনারা ছুচু (Cuju) নামের একটি মজার খেলা খেলে থাকে। চু (Ju) হচ্ছে চামড়ার তৈরি একধরনের বল, যাতে চুল গুজে দেওয়া হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, চীনের প্রাচীন আমলের হলুদ সম্রাট (Yellow Emperor) সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এই খেলা আবিষ্কার করেছিলেন। পরে, ঠাণ্ডা খাবার উত্সবের সময়, লোকজন এই খেলার মাধ্যমে, নিজেদের শরীর গরম রাখার কৌশল শিখে নেয়। কারণ, ঠাণ্ডা খাবার তাদের শরীর আরও ঠাণ্ডা করে দিচ্ছিল।
চীনারা মধ্য-শরত উৎসবে মুনকেক খেয়ে থাকে। অনেকটা তেমনি, ছিংমিং সৌরপদের প্রথম দিন তথা সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ উৎসবের দিন চীনের বিভিন্ন অংশে ডিম খাওয়ার রীতি চালু আছে। প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, এদিন ডিম খেলে সারাবছরজুড়ে শরীর ভালো থাকবে। হাজার হাজার বছর ধরে চীনে এই রীতি চলে আসছে।
প্রাচীনকালের চীনা মেয়েরা বিয়ের পর, সন্তান লাভের আশায়, অনেকগুলো সেদ্ধ ডিম বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে নিত এবং তারপর সেই ডিমগুলো নদীর পানিতে ডুবিয়ে রাখতো। লোকজন সেগুলো নদী থেকে তুলে খেতো। তখন এটা বিশ্বাস করা হতো যে, যত বেশি ডিম লোকজন খাবে, সংশ্লিষ্ট নারীর গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা তত বাড়বে। আজকাল অবশ্য এমন বিশ্বাস বলতে গেলে উঠেই গেছে। তবে, এখনও লোকজন বিশ্বাস করে যে, এদিন ডিম লেখে সাফল্য এসে ধরা দেবে।
ইয়াংজি নদীর নিম্ন অববাহিকায়, ছিংমিং সৌরপদের প্রথম দিন ছিংথুয়ান (Qingtuan) বা সবুজ কেক খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। ছিংথুয়ান হচ্ছে একধরনের গোলাকার সবুজ কেক। এই কেকের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে ঘাস। এটা তৈরি করতে ময়দাও লাগে। কেকে পুর হিসেবে ব্যবহার করা হয় কালো বিন। এই কেক খেতে মজা ও চমৎকার গন্ধযুক্ত। সমাধি পরিচ্ছন্নকরণ দিসবে লোকেরা এই কেক পূর্বপুরুষদের কবরে নৈবেদ্য হিসেবেও উত্সর্গ করে থাকে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
[email protected]
এইচআর/এমএস