রমজান
অফিস সময় কমলো রাস্তার সময় বাড়লো কেন?
শুরু হয়েছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। কুপ্রবৃত্তি থেকে রক্ষা ও আত্মশুদ্ধির জন্য সর্বোত্তম মাস হচ্ছে রমজান। পুণ্যময় এই মাস রহমত, বরকত ও মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। সংযত সুন্দর জীবনের শিক্ষা দেয় রমজান। বস্তুত মুসলিম বিশ্বের কাছে বহুল কাঙ্ক্ষিত মাস হচ্ছে পুণ্যময় এই রমজান। মাসজুড়েই একটি ধর্মীয় আবহ বিরাজ করে।
এই মাসে প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকের জন্য সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা ফরজ। পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তাগিদ দেওয়া হয়েছে জাগতিক সব বিষয়ে সংযত জীবন-যাপনের। সব ধরনের অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকাও রমজানের শিক্ষা।
শুধু না খেয়ে থাকাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং মুখ ও জিহ্বা সংযত রাখতে হবে। সংযমের পরিচয় দিতে হবে সবক্ষেত্রে। ন্যায়নীতি ও শুভবোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে। নিজের ও অপরের ওপর জুলুম করা, অন্যায় করা থেকে বিরত থাকা সিয়াম সাধনার অন্যতম লক্ষ্য। এর মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এই ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সরে গিয়ে নানা রকম অসঙ্গতি দেখা দেয় সমাজে। এটা দুঃখজনক।
রমজান এলেই নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন দেখা যায়। রমজানে অপরিহার্য এমন অনেক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায় কোনো কারণ ছাড়াই। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফার লোভে কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, যা রমজানের চেতনার পরিপন্থি। অন্যদিকে এ সংযমের মাসেই দেখা যায় বিত্তশালীদের বাড়াবাড়ি। তারা খাদ্যের অপচয় করেন। অথচ অনাহারি ও অভাবক্লিষ্টরা কতো কষ্টে থাকে। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করাও রমজানের শিক্ষা।
দুই.
রমজানে জনভোগান্তি দূর করার জন্য সব সময়ই দাবি থাকে। কিন্তু দেখা যায় এই সময়ে নানা ক্ষেত্রে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যানজট তীব্র আকার ধারণ করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংকট দেখা দেওয়া, ভেজালের সমারোহ বৃদ্ধি ইত্যকার নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকে মানুষ। সবকিছু মিলিয়ে এক অরাজক অবস্থা। অথচ সংযমের মাস পবিত্র রমজানে সবক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতা ও নীতি-নৈতিকতার উন্মেষ ঘটার কথা।
যে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ান তিনি অন্তত রমজানে তা করবেন না, যারা খাদ্যে ভেজাল মেশান তারা তা থেকে বিরত থাকবেন, যানজট দূর করতে আগের থেকেও সক্রিয় হবে পুলিশ- এভাবে সবক্ষেত্রেই একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চায় মানুষ। কিন্তু রোজার প্রথম ধাক্কাটা লাগে পণ্যের বাজারে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। এই রমজানে পোল্ট্রি মুরগির দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্য মুরগি ও মাংসের দাম। লোকজন আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
অথচ অন্য দেশে কোনো উৎসব পার্বণে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ভালোভাবে সবাই সেই উৎসবে অংশ নিতে পারে। আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্র। এ ব্যাপারে অনেক কথা হলেও কাজের কাজ খুব কমই হয়। এবারও রমজানের শুরুতেই প্রয়োজনীয় অনেক নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।
ভোক্তাদের পকেট কাটা যাবে আর প্রশাসনযন্ত্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে এটা হতে পারে না। এ ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ন্যায্যমূল্যে ভোক্তারা পণ্য পায়। টিসিবির কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তারা যেন ন্যায্যমূল্যে চাল, ডাল, চিনি, ছোলার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে রোজার শুরু থেকেই যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অফিসগামী ও অফিস ফেরতদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। শুধু ব্যবস্থাগত ত্রুটি এবং অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে যানজট এত তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু যানজট দূর করতে বাড়তি কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না।
সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও যানজট সৃষ্টি হয়। বছরজুড়েই চলতে থাকে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি। দেখা যায় একটি সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ করেছে তো অন্য সংস্থা আবার শুরু করে। এতে শুধু যানজটই হচ্ছে না, রাষ্ট্রীয় অর্থেরও শ্রাদ্ধ হচ্ছে। এজন্য সমন্বয়ের কথা বলা হলেও কে শোনে কার কথা।
রমজান মাসে অফিসের সময় কমে যাওয়ায় পুরো ১২ ঘণ্টার চাপ এখন ৮ ঘণ্টায় ঠেকেছে। সংগত কারণেই যানজট বেড়ে গেছে- এমনটি বলছেন ট্রাফিক পুলিশ। প্রতি বছরই তো রমজানে অফিস সময় কমিয়ে দেওয়া হয়। এটা তো নতুন কোনো বিষয় নয়। তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থা সেভাবে ঢেলে সাজানো হয় না কেন? হলেও তার ফল পাওয়া যায় না কেন?
যাত্রীবাহী বাসগুলো যানজট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। যেখানে সেখানে এলোপাতাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো হয়। লেন মেনেও চলে না যানবাহন। এমনকি রাজধানীতে মোটরসাইকেল আরোহীদেরও যানজটে আটকা থাকতে হয়। সামান্য এতটুকু রাস্তা ছাড়তে রাজি নয় বড় গাড়িগুলো। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেট কার) সংখ্যাও মারাত্মক পরিমাণে বেড়েছে। এটিও যানজটের অন্যতম কারণ।
যানবাহনগুলো নিয়ম মেনে না চললেও সেগুলো দেখার কেউ নেই। কিন্তু এ অবস্থা চলতে পারে না। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। আইনলঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রমজানে অফিস সময় কমিয়ে দেওয়া হয় যাতে পরিবার-পরিজনের সাথে সবাই মিলে ইফতার করতে পারে। কিন্তু সে সময় যদি রাস্তায়ই নষ্ট হয়ে যায় তাহলে এরচেয়ে দুঃখজনক আর কী থাকতে পারে। রোজাদাররা যাতে সময় মতো বাসাবাড়িতে গিয়ে পরিবার-পরিজনের সাথে একত্রে ইফতার করতে পারে এজন্য যানজট দূর করতে হবে যে কোনো মূ্ল্যে।
তিন.
যানজট দূর করা, দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা, ভেজাল বন্ধ করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ঠিক রেখে জনভোগান্তি দূর করাই হবে এই মুহূর্তের করণীয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এমনটিই দেখতে চায় মানুষজন।
রমজানের তাৎপর্য অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। এই মাস সবার জীবনে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসুক- মহান আল্লাহর নিকট এটাই আমাদের প্রার্থনা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এএসএম