নারীর মুক্তি
নিজস্ব ঘর এবং ল্যাপটপ
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জেন্ডার সমতার জন্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন’। জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে দরকার সব ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু প্রযুক্তিসহ সবখাতেই নারী পুরুষের মধ্যে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। বেগম রোকেয়ার আমলে ছিল, স্বামী যখন চন্দ্র সূর্যের দূরত্ব নিয়ে চিন্তা করেন স্ত্রী তখন বালিশের ওয়ার কত বড় হবে সেটা মাপেন। দৃশ্যপট যে সেসময় থেকে খুব বদলেছে তা নয়। স্বামী যখন নোয়া হারিরির স্যাপিয়েন্স পড়েন, স্ত্রী তখন ভারতীয় বাংলা চ্যানেলে সিরিয়াল দেখেন যেখানে শুধু পারিবারিক কূটচাল ছাড়া তেমন কিছু শিক্ষণীয় নেই। অবশ্যই এখানে সকলের কথা হচ্ছে না। তবে অনেকেরই এই হাল।
সিরিয়াল দেখা বা নাদেখা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। এটা যার যার অভিরুচি।অনেক পুরুষও সারাক্ষণ স্পোর্টস চ্যানেলে পড়ে থাকেন। আমার বক্তব্য হলো নারীকে (এবং পুরুষকেও) হতে হবে বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তির জ্ঞান সম্পন্ন। তাকে জানতে হবে প্রযুক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়।
সমাজ থেকে নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হলে প্রথমেই দরকার নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। টাকা যার হাতে, ক্ষমতা তার হাতে। আর একবিংশ শতকে তথ্য যার হাতে ক্ষমতা তার হাতে। অর্থনৈতিকভাবে নারী যদি স্বাবলম্বী না হতে পারে তাহলে পারিবারিক ও সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে কখনও ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না।
নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দরকার শিক্ষা। আর এখন শিক্ষার জন্য তথ্য প্রযুক্তি অত্যন্ত জরুরি। আমার নিজের মনে আছে নব্বই দশকে যখন কম্পিউটারের ব্যবহার বাংলাদেশে শুরু হলো তখন তরুণ তো বটেই মধ্য বয়স্ক পুরুষরাও কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য দ্রুত কম্পিউটার চালাতে শিখে গেলেন। কিন্তু মধ্যবয়স্ক নারীরা ততো দ্রুত এখানে প্রবেশাধিকার পাননি। এরজন্য অফিসের পরিবেশের পাশাপাশি নিজেদের অনীহাও কিন্তু কিছুটা হলেও দায়ী। মধ্যবিত্ত ঘরের অনেক মধ্যবয়স্ক বা প্রবীণ গৃহবধূ এখনও কম্পিউটার চালাতে জানেন না। কোনো কাজের প্রয়োজন হলে তিনি হয়তো তার ছেলে বা মেয়েকে সেটার জন্য অনুরোধ করেন। অবশ্য এখন দিন বদলেছে। এখন শিক্ষার্থীরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রযুক্তিগত শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে। এখন স্মার্ট ফোন সকলের হাতে হাতে। সেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনেক নারী নিজের জীবিকা অর্জনের পথ খুঁজে নিয়েছেন। ইকমার্স এখন একটি জনপ্রিয় বিষয়। অনলাইনে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের পণ্য বিক্রি করছেন যাদের মধ্যে অনেক নারীও আছেন।
শুধু তথ্য প্রযুক্তি নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীর এগিয়ে আসা দরকার। গাড়ির মেকানিক বলুন আর ফ্রিজ মেরামত কর্মী এদের মধ্যে কতজন নারী পাবেন? নারী প্রকৌশলীর সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়লেও এখনও সমতার পথ বহুদূর। বুয়েটের আর্কিটেকচারে অনেক নারী আছেন কিন্তু কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নারীর সংখ্যা এখনও পুরুষের চেয়ে কম। এসব দিকে নারীর উচ্চশিক্ষায় আরেকটি বাধা হলো কম বয়সে বিয়ে। ঠিক বাল্যবিয়েও নয়। আঠারো বা ঊনিশ-কুড়ি বছরে এখনও অনেক নারীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি, স্বামী সন্তান সামলে কোনো নারী যদি লেখাপড়াটা কোনক্রমে চালিয়েও নেন তবু সেটা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা স্থানীয় কোন কলেজে সমাজবিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে।
নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গে আরেকটি কথাও বলতে চাই। সেটি হলো নারীর স্বাধীনতা ও প্রাইভেসি। বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীরই নিজস্ব কোন ঘর তো দূরের কথা একটি ড্রয়ারও নেই। উচ্চবিত্ত এবং কর্মজীবী মধ্যবিত্ত নারীর কথা বলছি না। আমি বলছি তৃণমূল পর্যায়ের নারী, নিম্নবিত্ত নারী এবং মধ্যবিত্ত গৃহবধূদের কথা।
আমি অনেক মধ্যবিত্ত লেখক নারীকেও জানি যার নিজস্ব কোনো ল্যাপটপ নেই। এমনকি পঞ্চাশ বা ষাট বছর পার হয়েছে এমন অনেক নারী এখনও জানেন না কীভাবে নিজের লেখা কম্পোজ করতে হয়।
এজন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন? সমাজ ব্যবস্থা তো অবশ্যই। পাশাপাশি নিজেকেও কিন্তু উদ্যোগী হতে হবে।
নারীর নিজস্ব ঘর এবং নিজের একটি ল্যাপটপ থাকা দরকার। কিন্তু সেটি আপনাকে কেউ হাতে এনে ধরিয়ে দিবে না। নিজের ঘর, নিজের ল্যাপটপ আপনাকে অর্জন করে নিতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। নারী দিবস মানে শুধু ফুল উপহার পাওয়া কিংবা পার্পেল কালারের পোশাক পরা নয়। আপনি ‘ঘর সামলান, বাইরে সামলান’ এবং নিজেকে সুপার উয়োম্যান হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে আরামকে বিসর্জন দেন সেটাও নয়। নারী দিবস মানে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেকে চিরদিন স্বাধীন রাখার জন্য শপথ গ্রহণ। সেই শপথ আপনি সম্মিলিতভাবেও নিতে পারেন অথবা মনে মনেও। নারী দিবস মানে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে চিন্তা করা, সচেতন হওয়া এবং সেটা দূর করতে সচেষ্ট হওয়া। নারী দিবস শুধু একদিনের কথা বলে না। নারী দিবস মানে শুধু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীর দিবস নয়। নারী দিবস মানে তৃণমূল থেকে শুরু করে সকল স্তরের, সকল পর্যায়ের নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া। এই সচেতনতা বছরের সবকটি দিনের জন্য।
সারাজীবনের জন্য। অভিভাবকরা সচেতন হোন যে নিজের পরিবারের কন্যাটিকে ঠিক ছেলের মতোই উচ্চশিক্ষা দিবেন এবং সে উপার্জন করার মতো উপযুক্ত না হলে তাকে বিয়ে দিবেন না। ছেলে মেয়ে সবাইকেই স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলুন। সকলেরই যেন প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার থাকে। যেন সকলেই নিজের নিজের অধিকারগুলো অর্জন করে নিতে পারে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম