আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩
আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তি ছাড়া নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব
প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির আগের নাম ছিল 'আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস'। বিশ্বব্যাপী এই দিবস উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীরা। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। দিবসটির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ তার সকল সদস্য রাষ্ট্রকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানায়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাল: জেন্ডার সমতার জন্য উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি’ (‘DigitALL: Innovation and technology for gender equality’)। সরকারিভাবে এ বছর বাংলাতে দিবসটির স্লোগান “ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন”।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৫ এ ২০৩০ সালের মধ্যে লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। লিঙ্গ সমতা শুধু একটি মৌলিক মানবাধিকার নয়, বরং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি। গত কয়েক দশক ধরে এক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে লিঙ্গ সমতা অর্জনের পথে নেই।
কভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। নারীদের অবৈতনিক যত্ন এবং গার্হস্থ্য কাজে ব্যয় করা সময়, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেটসহ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এ বছর দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে বর্তমানে আমাদের জীবন শক্তিশালী প্রযুক্তিগত একীকরণের উপর নির্ভর করে। অনলাইনে একটি কোর্সে অংশ নেওয়া, প্রিয়জনকে কল করা, ব্যাঙ্ক লেনদেন করা, বা একটি মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা সবকিছু একটি ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। তাসত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী ৩৭ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হলেও পুরুষদের তুলনায় ২৫৯ মিলিয়ন নারীর ইন্টারনেটে কম প্রবেশাধিকার রয়েছে।
জাতিসংঘ আরও উল্লেখ করেছে যদি নারীরা ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারে অক্ষম হন এবং অনলাইনে নিরাপদ বোধ না করেন তবে তারা ডিজিটাল জগতে জড়িত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন না, যা তাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত সম্পর্কিত পেশা অর্জনের সুযোগ হ্রাস করবে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চাকরি এই ক্ষেত্রগুলোর সাথে সম্পর্কিত হবে।
প্রযুক্তিতে নারীদের প্রবেশাধিকারের ফলে আরও সৃজনশীল সমাধান পাওয়া যায়, নারীর চাহিদা পূরণ করে লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করে এমন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা বেশি তৈরি করে।। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্ভুক্তির ঘাটতি বিপরীতে উন্নয়ন ও জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় সৃষ্টি করে।
বিশ্বব্যাপী বিগত ৫ বছরে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে এবং ২০২১ সালের শেষ নাগাদ, বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। এটি জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ই-কমার্স, আর্থিক পরিষেবা এবং আয়-উৎপাদনের সুযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং পরিষেবাগুলিতে প্রবেশাধিকারের সুযোগ প্রদান করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৩৭.০১ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এদের মধ্যে ৪৬.৫৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২৮.০৯ শতাংশ নারী।
২০২২ এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিবিএস এর অপর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে দেশের নারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। এছাড়া দেশের ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারে সেলুলার মোবাইল ফোন রয়েছে। পাশাপাশি স্মার্টফোন রয়েছে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারে।
প্রতিবেদনে তুলনামূলক একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ৮৭.৭ শতাংশ পরিবারে সেলুলার মোবাইল ফোন ছিল, সেটি বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ৯৭.৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে ইন্টারনেট ব্যবহার করত ৪. ৮ শতাংশ পরিবার, আর ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.১ শতাংশে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দিনে অন্তত একবার মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি। এছাড়া মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারেও এগিয়ে রয়েছে শহরের মানুষ। তবে শহর ও গ্রামের মধ্যে মোবাইল ব্যবহারের পার্থক্য খুব বেশি নয়। বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বেশি।
বিবিএসের এক জরিপ অনুযায়ী, স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৪১ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এসডিজি অনুযায়ী, ৮৬.২ শতাংশ মানুষ আইসিটি দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল কন্টেন্ট ও তথ্য কপি-পেস্ট ও ব্যবহার করতে পারে। ৮৩.৪ শতাংশ মানুষ মেসেজ পাঠাতে পারে। প্রোগ্রামিং এবং কোডিংয়ে মানুষের দক্ষতা অনেক পিছিয়ে।
বিবিএসের এক জরিপ অনুযায়ী, ৬৪ শতাংশ গ্রামীণ এবং ৫৮ শতাংশ শহুরে মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব করেন না। প্রায় ৪৮.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটকে ব্যয়বহুল বলে মনে করেন। এবং ৩৫ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সরঞ্জামগুলিকে ব্যয়বহুল বলে মনে করে।
মোবাইল ফোন সেবাদাতাদের গ্লোবাল সংস্থা জিএসএমএর ২০২২ সালের মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে দেশের পুরুষ ও মহিলা গ্রাহকদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ পুরুষ এবং ২১ শতাংশ নারী।
মোবাইলফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনই মনে করেন না, সামর্থ্য না থাকায় ব্যবহার করেন না ১১ শতাংশ, সুযোগ না থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না এমন মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তাজনিত কারণে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না।
মোবাইলফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে একজন ব্যক্তির আর্থসামাজিক উন্নতি নিয়ে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ও ঘানায় পরিচালিত একটি জরিপের বরাত দিয়ে ব্রন্ডব্যান্ড কমিশন বলেছে, মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় এই দুই দেশের মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর্থসামাজিক অবস্থান আগের চেয়ে অন্তত ৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই আর্থসামাজিক অবস্থানের উন্নতির হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন এমন ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ।
ডিজিটালভাবে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। তা সত্ত্বেও নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহারে বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য কমাতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই প্রযুক্তিতে নারীদের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি নারীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। সে জন্য প্রযুক্তির ভাষা সহজ হতে হবে। ডিভাইসের প্রাপ্যতা বাড়াতে হবে। ইন্টারনেট খরচ কমাতে হবে। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে অনলাইনে যে সহিংসতা বাড়ছে তা থেকেও নারীদের রক্ষা করতে হবে।
প্রযুক্তির ভাষাকে সাধারণ জনগণের কাছে নিয়ে আসার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করা একটি মেয়েকেও প্রযুক্তি অধ্যয়নে উৎসাহিত করতে হবে। নিরাপদ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং প্রুযুক্তি শিক্ষার বাজেট বাড়াতে হবে।
অনেক নারী উদ্যোক্তা এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। একজন মহিলা যেকোন পেশায় প্রবেশ করতে চাইলে তাকে প্রযুক্তিগত বিষয়ে ভালো ধারণা ও জ্ঞান থাকতে হবে। প্রযুক্তির ভয় প্রযুক্তি শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই ভয় কাটিয়ে উঠতে স্কুল থেকেই শিশুদের প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রযুক্তিকে হাতের নাগালে নিয়ে আসতে হবে, যেন সবাই তা ব্যবহার করতে পারেন। বাংলাদেশকে উদ্ভাবনের জায়গায় দেখতে চাইলে প্রযুক্তিতে মেয়েদের সুযোগ দিতে হবে। একটু প্ল্যাটফর্মের সুযোগ দিলে নারীরা অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রান্তিক, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদেরকে প্রযুক্তি শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয় থাকতে হবে।
প্রযুক্তি নারীকে আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে। যেসব নারী বাইরে কাজ করতে গিয়ে পরিবারের বাধার মুখে পড়েন, তাঁরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকাকেও এখন মৌলিক অধিকারের মধ্যে ধরতে হবে বলে তারা মনে করেন।
অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীরা পারিবারিক বাধা ও সামাজিক সংস্কারের কারণে আইনি পদক্ষেপ নিতে ভয় পান। আইনি সহায়তা নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দিতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অনলাইন ব্যবহারে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে নারীদের সতর্ক হতে হবে।
স্মার্ট বংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহারে নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিকল্প নেই। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও উদ্ভাবন দিয়ে গড়ে ওঠবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ। আর এভাবেই সম্ভব হবে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারী অধিকার আন্দোলনের একটি স্মারক দিবস। এই দিবসের অনুশীলনটি হল নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। বর্তমানে আমরা যদি নারীর ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পূরণ করতে পারি, তাহলে দিবসটি উদযাপন সার্থক হবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/এএসএম