রম্য
তিনি দেখলেন ছাহেরা সেই পুকুরে গোসল করছে!
মামলা-মোকদ্দমাকে যমের মতো ভয় পান আলী নেওয়াজ। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। বছর তিনেক আগে হঠাৎ একদিন আলী নেওয়াজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন-তিনি একটি আদর্শ খামার প্রতিষ্ঠা করবেন; যেখানে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও মৎস্য চাষের ব্যবস্থা থাকবে।
সারাজীবনের সঞ্চয় এ খামারের পেছনে খরচ করে এবং রাত্রি-দিন নিরলস শ্রম দিয়ে যখন লাভের কড়ি গোনার প্রহর গুনছেন আলী নেওয়াজ, তখন একদিন ভোরবেলা ফজরের নামাজ শেষ করে পুকুরঘাটে এসে দাঁড়াতেই দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে তার।
বার বার চোখ কঁচলেও যখন তার সন্দেহ ঘুঁচল না, তখন ঘাটে নেমে চোখ-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ফের তাকালেন সামনে। তার চোখ পুনর্বার তাকে সেই একই দৃশ্য দেখাল। তিনি দেখলেন, পুকুরের সব মাছ মরে ভেসে আছে জলে। শিরঃদাড়ায় ঠান্ডা স্রোতের একটা শিহরণ অনুভব করলেন আলী নেওয়াজ। এরপর আর কিছু মনে নেই তার।
জ্ঞান ফেরার পর আলী নেওয়াজের কাছের লোকজন তাকে পরামর্শ দিল থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা করার জন্য। আলী নেওয়াজের মতো ভদ্র, সহজ-সরল, নিরিবিলি প্রকৃতির লোকেরও গ্রামে শত্রুর অভাব ছিলো না। এরকম একটি কাজ কার দ্বারা সম্ভব, তা অন্যরা যেমন বুঝতে পেরেছে, তেমনি বুঝতে পেরেছেন আলী নেওয়াজও। কিন্তু থানা পুলিশের প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন মাথা নেড়ে আলী নেওয়াজ বললেন, ক্ষতি যা হবার তাতো হয়েছেই, এখন সেইসঙ্গে শান্তিটাও যাক-এটা আমি চাই না। অতএব আলী নেওয়াজ থানায় গেলেন না।
আলী নেওয়াজ নিজে থেকে যদি পণ করেন, তিনি থানায় যাবেন না; সে ভিন্ন কথা। কিন্তু অন্য কেউ যদি প্রতিজ্ঞা করে, আলী নেওয়াজকে তিনি থানায় নিয়েই ছাড়বেন, তাহলে আলী নেওয়াজের কী আর করার আছে? কাজেই আলী নেওয়াজকে থানায় যেতে হলো। অভিযোগ গুরুতর। আর এই গুরুতর অভিযোগটি করেছেন তার প্রতিবেশী নাসু মন্ডল।
পুলিশ এসে আলী নেওয়াজকে থানায় নিয়ে গেল এবং তারপর কোর্টে চালান করে দিল। আলী নেওয়াজের আত্মীয়-স্বজন কোর্টে গিয়ে তার জামিনের ব্যবস্থা করল। যে উকিল মারফত জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাকেই মামলা পরিচালনার ভার দেয়া হল। পরদিন সকালবেলা আদালত প্রাঙ্গণে উকিলের চেম্বারে যাওয়ার পর উকিল তাকে বলল-
: নেওয়াজ সাহেব। নাসু মন্ডল তো টাকা-পয়সা দিয়ে থানা-পুলিশ সব হাত করে ফেলেছে। আর কেইসও তো একখান ফিট করছে জব্বর। নারী অপহরণ, অতঃপর ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ গুম।
: মিথ্যা অভিযোগ। সব মিথ্যা, সাজানো। আমাকে হেয়, অপদস্থ করার জন্যই এসব করেছে ব্যাটা!
: আপনাকে অপদস্থ করে তার কী লাভ?
: আমার বাড়ির সামনের জমিটুকু দখল করার অপচেষ্টা এটা। মন্ডল হয়তো ভেবেছে, আমি বেকায়দায় পড়ে তার কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হবো।
: ছাহেরা নামের যে মেয়েটিকে ভিকটিম করা হয়েছে, সে মন্ডলের কী রকম আত্মীয়?
: লতায়-পাতায় আত্মীয়; কাছের কেউ না। তবে আত্মীয় হিসেবে সে মন্ডলের বাড়িতে থাকত না, কাজের মেয়ে হিসেবে থাকত। আমার ধারণা, মন্ডল সেই মেয়েকে কোথাও লুকিয়ে রেখে আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে।
: কোর্ট তো এসব মানবে না। কোর্ট চাইবে প্রমাণ। মেয়েটা এখন কোথায় আছে, জানতে পারলে জব্বর একটা কাজ হইত। হুম, দেখা যাক কী হয়। দেন, টাকা দেন।
: কত?
: আপাতত হাজার দশেক দেন।
: এত টাকা?
: এত টাকা মানে? আপনে কি আমারে বটতলার উকিল মনে করছেন?
ধমক খেয়ে পুরো দশ হাজার টাকাই উকিলের হাতে তুলে দেয়ার পর ওকালতনামায় সই-সাবুদ করে বাড়িতে ফিরে এলেন আলী নেওয়াজ। তবে মনে কোনো শান্তি পাচ্ছিলেন না। এত বড় একটা মিথ্যা কলঙ্ক যে তাকে বয়ে বেড়াতে হবে, এটা তিনি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন সুখবর পাওয়া গেল। আদালতে পরবর্তী হাজিরার ঠিক একদিন আগে ছাহেরার খোঁজ পাওয়া গেল। পাওয়া গেল না বলে বলা উচিত আবিষ্কার করা হলো।
মামলার খরচ চালানোর জন্য আলী নেওয়াজ মুক্তাগাছা গিয়েছিলেন গরু বেচতে। গরু বিক্রি শেষে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য মহারাজ শশীকান্তের সান বাধানো পুকুরঘাটে যাওয়ার পর তিনি দেখলেন, ছাহেরা সেই পুকুরে গোসল করছে। আড়ালে থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর মেয়েটি যে ছাহেরা, তা নিশ্চিত হবার পর আলী নেওয়াজ মুক্তাগাছা থানায় গিয়ে পুলিশকে জানানোর পর মহারাজাদের পরিত্যক্ত ভবনের অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠ 'ধর্ষণ এবং অতঃপর হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা’ ছাহেরাকে গ্রেফতার করা হলো।
পরদিন এসব উত্তেজনাকর খবর নিয়ে ভোরের ট্রেনেই আলী নেওয়াজ ময়মনসিংহ জেলা জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে হাজির হলেন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরও উকিল সাহেব চেম্বারে না আসায় আলী নেওয়াজ কাছের একটা হোটেলে গেলেন চা-নাস্তা খেতে। সেই হোটেলে আলী নেওয়াজের মামলা পরিচালনাকারী উকিলের মহুরি বসে সিগারেট ফুঁকছিল। আলী নেওয়াজ তার কাছে গিয়ে কিছু বলার আগেই মহুরি তাকে বলল-
: অন্য উকিল ধরেন ভাই।
: কেন! বর্তমান উকিল কী দোষ করছে?
: তাইনে তো কোর্ট-হাজতে...
: হাজতে! কী জন্য! বিষয় কী?
: বিষয় দুই নম্বরী। সার্টিফিকেট ছাড়াই উকিল হইছিল। গোপন এই কথাডা ফাঁস হইয়া যাওয়ায় তাইনে ফাইস্যা গেছেন; আমারেও ফাঁসাইয়া দিয়া গেছেন...
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]
এইচআর/এমএস