ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ফুলপরীর অভিযোগ

চিরতরে বন্ধ হোক র‍্যাগিং

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ০২ মার্চ ২০২৩

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মোটামুটি পুরনো ও নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে চলছে আলোচনা সমালোচনা। যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা সেটি কোনোভাবেই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্মানের নয়।

ফুলপরী নামে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রীকে গণরুমে আটকে রেখে সারারাত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। আর এই অভিযোগের মূল আসামী বাংলাদেশে ছাত্রলীগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি সানজিদা নামের একই বিভাগের একজন সিনিয়র ছাত্রী। ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশে একটি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে একটি ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি মোট তিনটি তদন্ত কমিটি কাজ করেছে। এসব তদন্ত কমিটি তাদের নিজ নিজ রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরও করেছে। ঘটনার সত্যতা পেয়েছে সবাই। সানজিদার নির্দেশে কয়েকজন মিলে ফুলপরীর উপর নির্যাতন চালিয়েছে সেদিন। যদিও ঘটনা ঘটেছিলো ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ কিন্তু ব্যবস্থা নিতে নিতে মার্চ মাস চলে এলো।

এই ঘটনার মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি দুর্বল দিক প্রকাশ পেয়েছে। এমনিতেই দেশে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগেরই বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। প্রশাসনের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাই ছিল হাতেগোনা কয়েকটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাকিগুলোতেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে আসন বাণিজ্য বা জোর করে মিছিলে নেয়ার মত ঘটনা ঘটতো। কথা না শুনলে চড় থাপ্পড়ের মত ঘটনাও জানতাম আমরা। কিন্তু সেসবের সবকটিই ঘটতো ছেলেদের হলে। মেয়েদের হলে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা বা প্রতিযোগিতার হিসেব থাকলেও কখনই শারীরিক নির্যাতন বা মানসিক নির্যাতনের ঘটনার চিহ্ন দেখা যায়নি। মেয়েরা দলগত কার্যক্রম যে যার জায়গা থেকে নিজেদের মত করে চালাতো। হল প্রশাসনের ছিল কড়া নজর।

এটা ঠিক যে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি প্রশাসনের একপ্রকার পক্ষপাতিত্ব কাজ করতো আর সেটার পিছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণও আমাদের জানা আছে। কিন্তু এখন যতটা নির্লজ্জভাবে তারা ছাত্রনেতাদের তাবেদারি করে সেসময় কোনো শিক্ষক অন্তত নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে কিছু করতে যাননি। এখন আমরা কী দেখছি? ফুলপরীর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতিটি ব্যক্তির অবহেলার কথা উঠে এসেছে। হল প্রশাসনের আসল কাজই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ভালোমন্দ বা সময় অসময়ের দেখভাল করা। নিজেদের মধ্যে কোনো প্রকার কোন্দল হলে সেটাকে বাড়তে না দিয়ে মীমাংসা করার দায়টাও কিন্তু তাদেরই। অথচ একজন নতুন শিক্ষার্থীকে সারারাত আটকে রেখে নির্যাতন করলো আর শিক্ষকদের কাছে কোনো তথ্যই পৌঁছায়নি? গণরুম মানেতো সেখানে অনেক ছাত্রী থাকবে। তাহলে সেখানে উপস্থিত বাকি শিক্ষার্থীরা কেন সাহায্যে এগিয়ে আসেনি? কীসের ভয়? কাদেরকে ভয় করছে তারা? সবাইতো সেখানে পড়াশুনা করতেই গেছে। তারমানে রাজনৈতিক প্রভাব সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাবকে প্রভাবিত করেছে। প্রশাসনের উপর আস্থার জায়গাটি সেখানে শূন্যের কোঠায় আছে হয়তো। তারা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে এই ঘটনায় প্রশাসন এগিয়ে আসবে।

আবার এটাও বলা যায় যে ফুলপরীর ঘটনাই হয়তো প্রথম নয়। র‍্যাগিং এর নামে এমন নির্যাতন আগেও ঘটেছে যাকে তারা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে।

আমরা এর আগে বুয়েটসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে এমন নির্যাতনের খবর দেখেছি। র‍্যাগিং কেন করবে? সিনিয়র বলেই ছোটদের উপর নিজেদের খেয়াল খুশি চাপিয়ে দেয়ার অধিকার তাদেরকে কে দিয়েছে? ২০১৮/১৯ সালে বুয়েটে কয়েকজন শিক্ষার্থীর এমন র‍্যাগিং এর সাথে জড়িত থাকার ঘটনায় চলে আসা রিটের ফলশ্রুতিতে হাইকোর্ট ২০২২ সালের মার্চে একটি যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেছিল। হাইকোর্টের ভাষায় সেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কিছু কথা। সেই রায়ে হাইকোর্ট সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে র‍্যাগিং বিরোধী কিছু পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনায় বলা ছিল র‍্যাগিং বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করবে, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুতেই শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের কাছ থেকে লিখিত নেয়া হবে র‍্যাগিং এর সাথে যুক্ত হলে কী হতে পারে বা কী শাস্তি দেয়া হতে পারে। র‍্যাগিংকে ফৌজদারি অপরাধের সাথে তুলনা করেই হাইকোর্ট এমন ৬ টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সেসব মানা হয়েছিলো? র‍্যাগিং প্রতিরোধে কোনো কমিটি কি গঠন করা ছিল?

র‍্যাগিং একটি সামাজিক সমস্যা। এটিকে প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। র‍্যাগিং এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে যায়। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারে। অনেকসময় কেউ কেউ আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলে।

ইতিমধ্যেই যেহেতু দোষীদের প্রমাণ পাওয়া গেছে আশা করছি তাদেরকে কেবল বহিঃষ্কার করেই থেমে যাবেনা এই প্রক্রিয়া। অপরাধী ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ঠ প্রশাসনকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এমন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সাহস না পায় তারজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে সে রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। রাজনৈতিক আশ্রয় বা পরিচয় নয় শিক্ষার্থীরা হলে বা ক্লাসে বসবে শিক্ষার্থী হিসেবে। সেখানে কেউ কারও জীবনের দায় নিবেনা।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন