ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অগ্নিঝরা মার্চ

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হোক দুর্নীতিমুক্ত

ড. হারুন রশীদ | প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ০১ মার্চ ২০২৩

মার্চ বাঙালির জীবনে এক অনন্য মাস। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় মার্চের প্রতিটি দিনই অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যময়। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন মাসজুড়েই নানা কর্মসূচি পালন করে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি জান্তারা সার্চলাইট অপারেশন চালিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, সর্বোপরি মুক্তিকামী জনতা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য আনুষ্ঠানিক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে এই মার্চ থেকেই।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যার হাতে যা আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার না ও পারি’ বলে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। এই দুর্গ গড়ে তোলার অর্থ যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা তা বুঝতে কারও বাকি রইলো না। শত্রুর মোকাবিলা করার দৃপ্ত আহ্বানও ভেসে উঠলো তার বজ্রকণ্ঠে। প্রয়োজনে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বললেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছিলেন বস্তুত সেই ম্যান্ডেটই তাকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।

এভাবেই ঘনিয়ে আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রী। পাকিস্তানি জান্তারা ভারী অস্ত্র, কামান নিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের নামে এ দেশের ছাত্র-জনতাসহ নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সেও হামলা চালায়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে গোটা জাতি। যার হাতে যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ। শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রাম। অতঃপর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ। অবসান হয় ২৩ বছরের বৈষম্য আর বঞ্চনার। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয়।

দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করলো বাংলাদেশ। এর মধ্যে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ হিসেবে ‘মুজিববর্ষ’ পালন করেছি। বাংলাদেশ নানাভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড রিজার্ভও। এখন যদিও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকটসহ বৈশ্বিক নানাবিধ কারণে রিজার্ভ কমেছে। তবে শিগগির তা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে-এমনটিই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদুৎ যুগেও এখন দেশ। মাতারবাড়িতে হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল উন্নয়ন যাত্রায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

এছাড়া মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। কমেছে বাল্যবিয়ে। বেড়েছে গড় আয়ু। যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এসেছে উন্নয়ন। উড়াল সেতু দৃশ্যমান এক উন্নয়ন বাস্তবতা। মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ফাইভ জির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশ।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করেছে বাংলাদেশ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাহার এবং নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক। দেশাত্মবোধেরও জাগরণ হয় পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে।

শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিন প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে পাঠ্যপুস্তক দিবস পালন করা হচ্ছে। চলতি বছরও ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক দিবস পালন করা হয়। যদিও করোনা মহামারির কারণে দেড় বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে মহামারিতে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক অনৈক্য, সংঘাত, সহিংসতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস এক প্রধান সমস্যা হিসেবেই এখানে রয়ে গেছে। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির সহাবস্থান সম্ভব নয় বলেই এই সংকট দূর হচ্ছে না- এমনটিই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এছাড়া জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বারবার। এসব সমস্যা উড়িয়ে একটি আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছাতেই হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ, এ অর্জন ধরে রাখতে হবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের মূলে আছে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আস্থাহীনতা। সেটা জাতীয় নির্বাচনই হোক আর স্থানীয় নির্বাচনই হোক। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে কিংবা কার অধীনে হবে- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না। এ অবস্থায় মনে রাখতে হবে, যখন সংকটের মূলে নির্বাচনব্যবস্থা তখন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও জাতীয় নির্বাচন জনপ্রত্যাশার মূলে।

এরই মধ্যে সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন একটি নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়েছে। বাংলাদেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল নিয়োগ পেয়েছেন। তার নেতৃত্বেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালিত হবে। সংবিধানে বর্ণিত আইনের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া প্রথম সিইসি হচ্ছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল, যার নেতৃত্বে গঠন করে দেওয়া হয়েছে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই কমিশন ইতিমেধ্যেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আশার সঞ্চার করেছে।

নিয়োগের প্রজ্ঞাপনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সিইসি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা না পান তবে তাকে নিয়েও ‘ইমেজ সংকট’ হতে পারে। অতীতের দুটি নির্বাচন কমিশনের ইমেজ সংকট আছে, সেটা কাটাতে কী করবেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইমেজ সংকট আমাকে নিয়েও হতে পারে। আমি যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের দলগুলোর সহযোগিতা না পাই, নির্বাচনী পরিবেশ অনুকূল না হলে আপনারা আমাকে দায়ী করবেন। আমাদের চেয়ে অনেক বড় হচ্ছে রাজনৈতিক দায়িত্ব।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা যদি মনে করে নির্বাচন কমিশন সুন্দর নির্বাচন করিয়ে দেবে, তাহলে ভুল-ভ্রমাত্মক ধারণা হবে। তাদের সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তারা আমার কাছে সহযোগিতা চায়, আমিও সহযোগিতা চাই।

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘জোরের সাথে বলব- সব দোষ নির্বাচন কমিশনকে দিলে আমি গ্রহণ করব না। রাজনৈতিক দলগুলোর রোল আছে, পুলিশ, আনসার, র‌্যাবকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি ওদের কমান্ড করব না। আমি এসপিকে বদলি করতে পারব না। আমি কমান্ড করলে কেউ রাইফেল নিয়ে দৌড়াবে না।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার যথার্থই বলেছিলেন। আসলে সবাই কমিশনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। কেউ নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে আগ্রহী নন। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য অনেকগুলো নিয়ামক কাজ করে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সমর্থক, ভোটার, স্থানীয় প্রশাসন- সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সব পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে।

মার্চ মাসেই বাঙালি তার চেতনাকে নতুন করে শাণিত করে। নতুন শপথে বলীয়ান হয়। অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে অগ্নিঝরা মার্চ প্রতিবারই আমাদের নতুন করে পথ দেখায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব দেশপ্রেমিক দলকে চেতনাদীপ্ত মার্চে নতুন করে শপথ নিতে হবে। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবে তা করতে হবে রাজনৈতিক সংহতি ও ঐক্য বজায় রেখেই।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম