সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গল্প একটি উপলব্ধি
ভদ্রলোকের বসবাস এ গায়ে হলেও আদতে বাড়ি ভিন গায়ে। কোথায় তা অবশ্য ঠিকঠাক এ গায়ের কারো জানা নেই। গাঁয়ের মানুষ তাকে চেনে চিকিৎসক হিসেবে। ক’বছর এ গায়ে যখন কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল, মানুষ মারা যাচ্ছিল অকাতরে, তখন হঠাৎই তার এ গায়ে আগমন।
সে সময় ডাক্তার হিসেবে মানুষের কদরও পেয়েছেন। তারপর এক সময় যখন মহামারি চলে গেছে, তখন গায়ের বাজারে তার যে ডিসপেনসারি সেখানে শুরুতে কিছু কিছু রোগী হলেও ধীরে ধীরে কমেছে তার সংখ্যা। ডাক্তারের চিকিৎসায় রোগী ভালো হয় না এ নিয়ে গায়ের মানুষের মধ্যে কানাঘুষা বেশ। আর ডাক্তারও ঝেড়ে কাশতে পারেন না। মেট্রিক ফেল করে বড় এক ডাক্তারের চেম্বারে দু’বছর কম্পাউন্ডারির বিদ্যাটুকুই যে তার মূলধন।
ডাক্তারির সার্টিফিকেট তো দূরে থাক কোনো মেডিকেল কলেজের করিডোর কস্মিনকালে মাড়ানোর অভিজ্ঞতাওতো তার নেই। তা তার ডিগ্রি থাক চাই না-ই থাক, মান-সন্মান বোধটুকু তো আছে। ও পাড়ার করিম যখন ‘ছাইয়ের ডাক্তার’ বলে প্রেশক্রিপশনটা ছিড়ে মুখের উপর ছুড়ে বেড়িয়ে গেল তখন তার আতে ঘা টা লেগেছে মারত্মক। খালি মনে হচ্ছিল এর চেয়েতো মৃত্যুও শ্রেয়। মন খারাপ করে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল নেই।
স্বপ্নে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন জমরাজ। ডাক্তারের মন খারাপে গলেছে জমরাজের পাশান হৃদয়ও। স্বপ্নে তিনি ডাক্তারকে একটা টোটকা শিখিয়ে দিলেন। এরপর ডাক্তার যখনই রোগী দেখবেন, তিনি যেন খেয়াল রাখেন জমরাজ রোগীর কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন। জমরাজ যদি রোগীর মাথার কাছে থাকেন, তাহলে রোগ যাই হোক না কেন কোন একটা ওষুধ লিখে দিলেই চলবে। রোগী তাতে ভালো হবেই হবে।
আর জমরাজ যদি থাকেন পায়ের কাছে, তবে রোগ যাই হোক না কেন ডাক্তার যেন রোগীর আত্মীয়স্বজনকে চূড়ান্ত জবাব দিয়ে দেন। কারন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর যেখানেই নেয়া হোক না কেন সেই রোগী আর কিছুতেই সুস্থ হবেন না। এরপর থেকেই ঘুরতে শুরু করলো ডাক্তারের ভাগ্যের চাকা। শুধু এ গাঁ আর সে গাঁ নয়, ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে দূর-দুরান্তের রোগীদের লাইনও সারাদিন লেগেই থাকে।
অবস্থা এমন যে ডাক্তারের নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত নেই। কাজের চাপে ডাক্তার যখন প্রায় ভুলতেই বসেছেন জমরাজের সাথে তার স্বপ্নে প্রথম সাক্ষাৎপর্বটির কথা, এমনি একদিন ডাক্তারের ঘুমের মাঝে আবারো জমরাজের আবির্ভাব। জমরাজ দাঁড়িয়ে আছেন তার পায়ের কাছে। ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসেন ডাক্তার। ভাবেন এ শুধুই স্বপ্ন, সত্যি নয় মোটেও। কিন্তু কই জেগে থেকেও তো তিনি জমরাজকে নিজের পায়ের কাছেই দেখতে পাচ্ছেন।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি জায়গা পরিবর্তন করেন। আশা যদি জমরাজকে পায়ের বদলে মাথার কাছে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু আদতে গুড়ে বালি। ডাক্তার যতই খাটের এ মাথা থেকে ও মাথায় ছুটোছুটি করেন না কেন, জমরাজ ঠিকঠিকই ঠায় দাঁড়িয়ে তার পায়ের কাছে। সকাল হতে গায়ের লোকে জানতে পারলো তাদের প্রিয় ডাক্তারের ঘুমের মধ্যেই জীবনাবসান হয়েছে।
তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হলো। মৃত্যুর পরও ডাক্তার ফেসবুকে ভাইরাল থাকলেন সপ্তাহ খানেক। তারপর এক সময় সব শেষ। আর দশ জনের বেলায় যাই হয় ডাক্তারের কথাও এক সময় ভুলে বসলো গাঁয়ের লোকেরা। ডিসপেনসারিতে এখন নতুন ডাক্তারের পসার। হাতযশ ভালো, রোগীও তিনি ভালোই পাচ্ছেন।
হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে গল্পটা ফরওয়ার্ড করেছেন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। এক সময়কার ডাকসাইটে কলামিস্ট। ইদানিং কম লেখেন, তবে মাঝে সাঝেই আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কলামের খোরাক যোগান দেন। এ রকমই একটা গল্প ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভালোই ছড়িয়েছে। বিরোধী রাজনীতির একজন বড় নেতা সরকারি দলকে উদ্দেশ্য করে গল্পটি বাজারে ছেড়েছেন।
আমার কিন্তু গল্পটা পড়ে উল্টো তার জন্যই করুণা জাগছিল। বাঁচার জন্য ‘ভবন’ আর ‘দমনের’ রাজনীতি জেরে ডুবতে বসা দলটা আঁস্তাকুড় থেকে উঠে আসার কত চেষ্টাইতো করলো। কখনো রাজাকারের ঘাড়ে সাওয়ার হয়ে তো কখনো রাজাকারকে কোলে নিয়ে, কখনো মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে তো কখনো বাসে আগুন বোমা ছুড়ে চেষ্টাতো তারা কম করেনি।
দফায় দফায় বদল করেছে ইমামও। মাকে বাদ দিয়ে সামনে আনা হয়েছে ছেলেকে। লাভের লাভ হয়নি তাতে কিছুই। দুনীর্তির দায়ে দণ্ডিতদের মানুষ গ্রহণ করেনি। বরং যুদ্ধাপরাধই আর সন্ত্রাস সংশ্লিষ্টতা তাদের ক্রমেই মানুষের কাছ থেকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছে। ভাড়া করে আনা হয়েছে ক্ষ্যাপের নেতাকে। কাজতো হয়ইনি, নেতা বরং তরী ডুবতে দেখে নির্বাচনের মাঠ থেকে খামোশ বলতে বলতে সটকে পড়েছেন।
পীর মানা হয়েছে ভিন দেশীদেরও। বিদেশী পীরকে তুষ্ট করতে কোটি টাকা খরচ করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে লবিস্ট নামধারী দালালদেরও। শেষে কোথাও কোন কুল কিনারা করতে না পেরে এখন হাঁটে-মাঠে, পথে-প্রান্তরে যাকে পাওয়া যাচ্ছে তাকে দিয়েই একটা দল বানিয়ে ভারি করা হচ্ছে জোটে দলের সংখ্যা। হালে তাদের নেতা পঁচা বাম আর নাক টিপলে দুধ বেড়োয় এমন সব বাতিল পুচকে নেতারা।
বলাই বাহুল্য কাজের কাজ এত সব কিছুতে। কিছুই হচ্ছে না, যা হচ্ছে তাহলো ক্রমেই তাদের জায়গাটা নির্ধারিত হচ্ছে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরটায়। আমি সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের মত অতটা কঠিন হতে চাইনা। তাই ‘ভুয়া’ শব্দটা উচ্চারণ করছি না ঠিকই, কিন্তু তার সাথে আমিও শতভাগ সহমত, তাদের আজকের যে পদযাত্রা তা আসলে শবযাত্রারই নামান্তর মাত্র।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম