মো. সাহাবুদ্দিন
প্রথম নাগরিক রাষ্ট্রপতি
আগামী এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে রাষ্ট্রপতি পদে পরিবর্তন এলো। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বিচার ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. সাহাবুদ্দিন দুদকের সাবেক কমিশনার এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে বেছে নেওয়ার সময় তিনি ছিলেন আলোচিত ইসলামি ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান।
রুটিনমাফিকই হয়েছে এই পরিবর্তন। তবে পদে কে আসছেন তা নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। যেসব নাম এসেছিল, যে ধরনের ভবিষ্যৎদ্বাণী করা হয়েছে তার কোনোটাতেই সাহাবুদ্দিনের নাম ছিল না। স্বীকার করতেই হবে যে, এই নিয়োগ জাতি, বিশেষ করে রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যমের জন্য এক বড় ‘চমক’।
রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক নাকি তা নয়? কেন আওয়ামী লীগ নিজেদের দলেও একজন খুঁজে পেলনা? কেন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে বাছাই করা হলো? এরকম অসংখ্য কথা আলোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এতকিছুর পর, বাস্তবতা হলো জনাব সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের ২২ তম রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি এখন।
বর্তমানের সংসদীয়ব্যবস্থায়, বিশেষ করে, ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুরো শাসনব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সেখানে খুবই সীমিত। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করলেও প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত অন্য সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সম্পন্ন করেন। তবে দেশের যেকোনো আদালত কর্তৃক যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। এই পরোক্ষ ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে।
তাই সংশোধনী, আইন, বিধির বাইরে গিয়ে এই পদটিকে ঘিরে বড় ছবিটি দেখা জরুরি। কারণ রাষ্ট্রপতির অন্যতম নিরপেক্ষতার বড় প্রতীক। তাছাড়া একটি বড় কাজ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের সমাবর্তন ও নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় ‘দার্শনিক’ বক্তব্য উপস্থাপন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বিদায়ের পর তাঁর ডায়েরির কিছু অংশ ছেপেছিল সেখানকার পত্রিকাগুলো। এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ‘কংগ্রেসের আদর্শে বেড়ে উঠলেও দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এখন আদ্যোন্ত অরাজনৈতিক ব্যক্তি আমি। আমি এখন এই সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি। এখন থেকে সে ভাবেই নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমার সামনে এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে, যাঁরা রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন, কালক্রমে দেশের প্রধান হয়েছেন এবং অরাজনৈতিকভাবে নিজের কর্তব্য পালন করেছেন’।
তাই রাষ্ট্রপতি পদটিকে কেবল কাঠামো দিয়ে বিচার করা যাবেনা। দেখতে হবে রাষ্ট্রের প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে। আমাদের সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্রপতি সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
এই পদের চ্যালেঞ্জও অনেক। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনীতির কারণে সমাজ, পেশা, প্রশাসন, বিচারিক প্রথা সব বিভক্ত। বিদ্বেষ ও বিভাজনে পূর্ণ একটি দেশে গণতন্ত্রের সাংবিধানিক শীর্ষব্যক্তি রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করেন সবাই, এবং সেটা জরুরিও। কিন্তু এর পরও কথা আছে। নতুন রাষ্ট্রপতি যেহেতু দলহীন ব্যক্তি নন, শাসক দলের প্রার্থী হিসেবেই তিনি এই পদে আসীন হয়েছেন, তাই রাষ্ট্রপতিকে যথার্থ দলীয় এক পদাধিকারী রূপে দেখব নাকি তাকে দেখব দলমত নির্বিশেষে সবার অভিভাবক হিসেবে, সেই চ্যালেঞ্জটা আমাদেরও।
এমন নিরপেক্ষ ভাবনা যদি ভাবি, তাহলে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টান্ত অন্যান্য সাংবিধানিক পদাধিকারীরও অনুসরণ করা উচিত। এ ব্যাপারে প্রথমেই আসবে উচ্চ আদালতের বিচারকগণ, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের কথা। সাংবিধানিক মর্যাদা ও পদাধিকারে মণ্ডিত সবাইকে রাজনৈতিক সব ভূমিকা হতে, এমনকী জনজীবনের রাজনীতি-সম্পৃক্ত পরিসর হতে নিজেকে সযত্নে দূরে রাখা কর্তব্য।
দেশের ‘প্রথম নাগরিক’ রাষ্ট্রপতি। সাংবিধানিক প্রধান বলেই তাঁর পদের মর্যাদা বহুলাংশে তাঁর নিরপেক্ষতার উপরেও নির্ভরশীল। সংসদীয় গণতন্ত্রে কয়েকটি পদ থাকে, যা কঠোর সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা দাবি করে। সেই নিরপেক্ষতা কেবল পদাধিকারীর মনের মধ্যে থাকাই যথেষ্ট নয়, তাঁর দৈনন্দিন আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মধ্যেও তা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হওয়া জরুরি। এটি যতটা না আইন বা বিধির প্রশ্ন, তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন নৈতিকতার।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথ উত্তপ্ত করার প্রচেষ্টা আছে বিরোধী দল থেকে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নিবেনা বলে রাজপথেই দাবির ফয়সালা করতে চাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় কিনা সেই শংকা আছে। ঠিক এ জায়গায় কোনো জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা যদি প্রত্যাশিত হয়, তাহলে সেটাও মো. সাহাবুদ্দিনের জন্য এক বড় ভাবনা।
আমরা জানি, বর্তমান সিস্টেমে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আসলে প্রাণহীন। প্রধানমন্ত্রীই প্রকৃতই এক নম্বর ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতি হলেন ‘সেরিমোনিয়াল হেড’। কিন্তু তিনি যেহেতু, প্রথম নাগরিক, তাই তাঁর ভূমিকা দেখতে হলে দেখার ছবিটি বড় করে দেখতে শেখাই জরুরি।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস/এএসএম