আমার বইমেলা
যাচাই-বাছাই করে ভালো বইটি কিনুন
অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন অমর একুশে বইমেলা। দীর্ঘদিন পর মেলাটি মানুষের মুখের ভাষায় ফিরে এসেছে সম্প্রতি। বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে আরও বেশি বিস্তৃত ও শক্তিশালী হয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে মেলার বিরাটত্ব।
স্বাধীনতা তোরণ, স্বাধীনতা জাদুঘর এবং সরোবর ছোঁয়া মেলার মাঠটি এখন এতটাই সৌন্দর্য ছুঁয়েছে যে, না দেখলে বোঝাই যাবে না। আমরা জানি, দেশ-বিদেশে বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার সুনাম আছে সারা পৃথিবীতে। এত বেশি জনাসমাগম বুঝি পৃথিবীর অন্য কোনো মেলায় ঘটে না।
ভাষা ও স্বাধীনতা শহীদদের স্মরণে এত বেশি আবেগ অন্য কোনো জাতি ধারণ করে কি না জানা নেই। এ মেলার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হচ্ছে- মাসব্যাপী আয়োজন, মূল মঞ্চে নানা বিষয়ে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিনা টিকিটে প্রবেশের সুযোগ। এসব বিবেচনা করেই বুঝি-স্রোতের মতো লেখক পাঠক প্রকাশকের ঢল নামে।
কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া সাম্প্রতিক বইমেলাটি তার আগের ঐহিত্য ধারণ করে আছে চেতনায়। মেলায় দর্শক-পাঠকের উপস্থিতি বিবেচনা করেই সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই যে মানুষের উচ্ছ্বাস, তার মূল্যায়ন কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে হয় না। এর মূল্য শুধু ভালোবাসা দিয়েই দেওয়া যায়। মানুষ গত তিনটি বছর সেই সুখ অনুভব করতে পারেনি পুরোপুরি। করোনা মহামারি ও এ সংক্রান্ত মৃত্যুঝুঁকি বিবেচনা করে অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতো মেলা আয়োজনেও নেমে এসেছিল শিথিলতা।
এবছর সেই শংকা আর নেই। তাই মেলার শুরুর দিক থেকেই মেলার ভিড় প্রকাশক লেখক সবার মন ছুঁয়েছে। প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে এবং বিক্রিও হচ্ছে। তবে আরও বেশি বই প্রকাশের সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করেন প্রকাশকরা। অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মতো পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাগজ ও অন্যান্য প্রকাশনা সামগ্রীর মূল্য। যে কারণে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা বেছে নিয়েছেন সংযম সাধনা।
পাঠকও তা টের পাচ্ছে মর্মে। কারণ যে সব নতুন বই তারা কিনতে যাচ্ছে সেগুলো কিনতে হচ্ছে চড়া মূল্যে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত জীবন নাজেহাল। সব ক্ষেত্রেই টেনে ধরতে হচ্ছে খরচের লাগাম। কমাতে হচ্ছে চাহিদা, তার ওপর শখ করে বা দরকারে একটি বই কিনতে গেলেও এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে তারা। সারাংশে এবারের বইমেলার চড়া মূল্য ক্রেতাকে অবশ্যই শঙ্কিত করেছে।
কবি লেখকদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তাঁরা মেলার আয়োজন দেখে আনন্দিত। প্রকাশক তো তিন বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবেই। লেখক প্রকাশকের এই মেলবন্ধ সব সময় ছিল। তারা মিলেমিশে কাজ করছে। তবে, যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটি হলো- সব সময় সস্তা ও মধ্যমানের বা নিম্নমানের বইয়ের কাটতি সর্বাধিক হয়। বই কিনতে ভিড় পড়ে যায়। এবং অবমূল্যায়িত হয় ভালো বই। পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে তারা যেন যাচাই-বাছাই করে ভালো বইটি কিনে নেন।
একটি বিষয় আমাকে খুব আহত করে যে, প্রতি বছরই বইমেলার প্রাণ লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের আন্দোলনে নামতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত বছর শুধু ব্যতিক্রম ছিল। কর্তৃপক্ষ মেলার মধ্য মাঠে জায়গা দেওয়ায় কোনো কথা তোলেননি লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা। কিন্তু এবার আবার স্থান পরিবর্তন করায় সবাই নাখোশ হয়েছে। তবে সব বিবেচনা করে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা তা মেনেও নিয়েছেন।
প্রতি বছরই এভাবে স্থান পরিবর্তন না করে একটি নির্দিষ্ট জায়গা দিলে এই সমস্যা থাকবে না। তবে মেলার তৃতীয় দিনেও লাইট না দেওয়া, ব্যানার না থাকায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে অন্ধকারে ডুবে থাকতে হয়েছে শুরুতে। পরে অনেক বলাবলি করে সেটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কর্মীরা আড্ডা দেওয়ার জন্য কিছু বেঞ্চের আবদার করলেও সেটা মানতে গড়িমসি। এবং লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে কিছু অপ্রাসঙ্গিক স্টল বরাদ্দ চত্বরটির সম্মানহানি করেছে। প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনগুলো এতে অবমূল্যায়িত হয়। আশা করি আগামী বছর থেকে কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো খেয়াল রাখবে।
সব মিলে বইমেলার এবারের আয়োজন নান্দনিক, এতে কোনো সন্দেহ নাই। সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি সব সময় সংশোধনযোগ্য।
লেখক: কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/এমএস