ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমার বইমেলা

অগোছালো পাণ্ডুলিপিও বই হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মেলায়

অরুণ কুমার বিশ্বাস | প্রকাশিত: ১০:২৬ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বছর ঘুরে আবার এলো আমাদের প্রাণের মেলা- বইমেলা। এবারের বইমেলা নিয়ে লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের উচ্ছ্বাসের কিছু কমতি নেই। কেননা, গত কয়েক বছর কোভিড উনিশের মহাসংক্রমণে আতঙ্কিত ছিল বিশ্ব। কোভিডের ভয়ংকর সেই ছোবল আমরাও কিছু কম সহ্য করিনি। কিন্তু এবারে আর সেই কোভিডের ভয় নেই অথচ আছে অন্য উপদ্রব। কী সেই ভয় বা উপদ্রব! কাগজ ও ছাপাশিল্প সংশ্লিষ্ট অন্য জিনিসপত্রের আকাশচুম্বী দাম। আমার দীর্ঘ লেখকজীবনে কাগজের এমন আচমকা মূল্যবৃদ্ধি আর কখনও দেখিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাগজের দাম প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কাগজের এই অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধি এবারের বইমেলায় একরকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বইয়ের দাম প্রায় দ্বিগুণ হবে অথচ বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমাদের বইয়ের ক্রেতা-পাঠকদের পকেটে ইতোমধ্যে বেশ টানাটানি চলছে। আমাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা মিটিয়ে উপরি টাকা দিয়ে বই কেনার ব্যাপারটা এবার কতখানি সম্ভব হবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সময় বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন আমাদের প্রকাশকরা।

এতে একটি ব্যাপার অবশ্য হবে। বই প্রকাশের সংখ্যাও বোধ করি কমবে। শৌখিন ও অনাবশ্যক বইয়ের প্রকাশ কম হবে। কোনো প্রকাশকই এবার এমন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন না, যা কি না তাদের ইনভেস্টমেন্ট বা ছাপাবাবদ খরচ তুলতে ব্যর্থ হবে। আবর্জনা কমবে, সেই সাথে হয়তো কিছু ভালো বইও বাদ পড়বে, যা কি না মোটেও সুখের খবর নয়।

আশার কথা, দিন দিন মেলার পরিসর বাড়ছে, বাড়ছে ভিড়ও। আবার হতাশার বিষয়, সাহিত্য বাদ দিয়ে অনেক প্রকাশক এখন অন্যবিধ বইয়ের কাটতির দিকে মন দিচ্ছেন। ইংরেজি শিক্ষা, প্রণোদনামূলক বই, চাকরি পাওয়ার সহজ তরিকা, সেলিব্রিটি বুক এসব নাকি পাঠক এখন খুব ‘খাচ্ছে’। সত্যি কথা বলতে, সবকিছুর পেছনে মূল মোটিভেশন এখন একটাই- স্রেফ অর্থ উপার্জন। অনেক প্রকাশকও এখন সেই পথেই হাঁটছেন।

মেলা প্রাঙ্গণে ভিড় বাড়লেও ক্রেতা বা পাঠক ততটা নেই। পাঠকের সেই পুরোনো অভিযোগ- তেমন ভালো বা মানসম্পন্ন বই কই যে কিনবো! বিশ্বাস করুন, আমিও তাদের সঙ্গে খুব একটা দ্বিমত করছি না। ভালো মানের পাণ্ডুলিপির সংখ্যা স্রেফ অঙ্গুলিমেয়। অনেক লেখক আবেগতাড়িত হয়ে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই বই প্রকাশ করছেন।

আমি বিশেষত তরুণদের কথা বলছি। আবার বয়োজ্যেষ্ঠ কোনো কোনো লেখক প্রকাশকের তাগাদায় সাড়া দিয়ে তাড়াহুড়ো করে যা নয় তাই লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রেসে। বেশির ভাগ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের শক্ত-সামর্থ্য কোনো এডিটিং প্যানেল নেই, তাই অগোছালো পাণ্ডুলিপিও বেশ বই হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মেলায়।

আবার পাঠকেরও কিন্তু প্রস্তুতি চাই। আমাদের আছে অনেক হুজুগে পাঠক। তারা শুধু অটোগ্রাফ বা ফটোগ্রাফের আশায় বইমেলায় আসেন। পছন্দের লেখক মেলায় এলেই তবে তারা বইয়ের স্টলে ঢুঁ মারেন। তারা কী পড়ছেন কেন পড়ছেন নিজেই জানে না। মোটকথা লেখক-পাঠক-প্রকাশক, মেলাঙ্গনের ভিড় সবই আছে, শুধু প্রকৃত বা মানসম্মত সাহিত্যের কদরটাই যেন সেখানে অনুপস্থিত। দু-চারটে ভালো বই যে হয় না এমন নয়, তবে প্রয়োজনীয় প্রচার কিংবা পরিচর্যার অভাবে মনস্বী পাঠক তার খোঁজই পান না। মানে কী দাঁড়ালো? বইয়েরও প্রচার চাই, চাই পরিচর্যা, তবে তা যেন দৃষ্টিকটু না হয় বা মাত্রা না ছাড়ায়। সবকিছুতেই পরিমিতিবোধ থাকা জরুরি, নইলে তাকে স্থূল মনে হয়।

পুরস্কার নিয়ে বলবো! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওটা সৃষ্টিকর্মের গুণগত মান নয়, বরং অন্যবিধ উপায়ে সমাধা হয়। মুখচেনা, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এসবের কারণেই অনেক নাজুক ও নাদান লেখক-কবিও ইদানীং পদ-পদবি-পদক এসব পেয়ে যাচ্ছেন। পুরো সিলেকশন প্রক্রিয়া ঘিরে জম্পেশ একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়। কথাটা একটু ‘নিহিলিস্টিক’ শোনালেও বাস্তবতা অনেকটা এমনই। পুরস্কার যিনি পান তিনি তো মহা খুশি। আর অন্যরা তখন নিজ দায়িত্বে সেই পদকপ্রাপ্ত’র ফোরটিন জেনারেশনের ঠিকুজি-কোষ্ঠি সমূলে ব্যবচ্ছেদ করে।

আমরা চাই একটি পরিচ্ছন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হোক। যেখানে সাহিত্যের সুঘ্রাণ ছড়াবে। লেখক, পাঠক, প্রকাশক সবাই একে অপরের লেখা পড়বে এবং গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা করবে। অনেক সময় দেখা যায় প্রকাশক সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন অথচ তার কোনো বিশিষ্ট লেখক বা তাদের লেখা সম্পর্কে কিছু বলতে পারছেন না।

অর্থাৎ প্রকাশক শুধু বই ছেপেই দায় সেরেছেন, বইয়ের ভেতরে ঢোকেননি। আবার অনেক লেখক আছেন শুধু লিখেই যাচ্ছেন, সেই একই কথা বারবার বলছেন। যাকে বলে রিপিট কাস্টিং। ফলে পাঠক বিরক্ত হচ্ছেন, বুঝতে পারছেন যে ওই লেখকের স্টক শেষ, তার আর বলার মতো কিছু নেই।

আমাদের লেখকদের মাঝেও মিথষ্ক্রিয়া দরকার, একে অপরের লেখা পড়বেন, তবেই না নিজের খামতি বা উন্নতি তিনি বুঝতে পারবেন। অর্থাৎ পাঠের কোনো বিকল্প নেই। বই ভালোবাসেন বলেই না তিনি প্রকাশক হয়েছেন, হয়েছেন লেখক কিংবা পাঠক। জেনেশুনে বুঝে লিখলে বই যেমন কালোত্তীর্ণ হয়, পাঠক পড়ে আরাম পায়, কিন্তু এর অন্যথা হলে ফল হয় ঠিক উল্টো- সাহিত্যের নামে কিছু গারবেজ তৈরি হয়। তাই প্রত্যাশা করি, বোদ্ধা পাঠক ভালো বইটি বেছে নিয়ে পড়বেন এবং লেখা ও লেখকের সঠিক মূল্যায়ন করতে সমর্থ হবেন। তবেই না সার্বিক বিচারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের একুশে বইমেলা।

লেখক: সাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম