বাগযুদ্ধ
আত্মসমালোচনা, যেকোন চরিত্রের অহংবোধ প্রতিরোধের প্রাথমিক শর্ত। তবে তা প্রদর্শনে থাকার নজির দেখানো মানুষের অভাব রয়েছে। অন্তত, যারা দায়িত্বশীল পদে থাকেন! আমরা ধরেই নিই যে, ভুল করার কোনো সুযোগই নেই। আদৌতে কী তাই? যেমন, আমরা সবক্ষেত্রে সঠিক বলছি বা নির্ভুল কাজ করছি, তেমন করে নয় বিষয়টি। অথচ, ভুল স্বীকার করা কিংবা দক্ষতা প্রমাণ করার সুযোগ বা সত্যতা নিশ্চিত না করা গেলেও বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার উদাহরণ রয়েছে। যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আরেকটি সংকট ধরা দিচ্ছে। তা হল, মেধাহীন রাজনীতির ধারক হয়ে পড়া। যা ইচ্ছে বলতে থাকার গুরুত্বহীন ও হাস্যকর বচনে থেকে কথিত মুখপত্র সাজতে চাওয়া। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ বেড়ে যায়। তেমন উপলব্ধিতায় শাণিত হয়ে আমাদের দায়িত্ব তাই বাড়ছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। আর অন্যদের জন্যও বলতে চাই, আরো ধীরস্থির থেকে কার্যকর ও অর্থবহ রাজনৈতিক বার্তায় মুখর হয়ে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে।
বাকশক্তি, যেকোন রাজনীতিকের গুণাবলীর অন্যতম গুণ। একজন রাজনীতিক তাঁর কথার যাদুতে জনশ্রেণির জন্য আদর্শ নাম হতে পারেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন আওয়ামী লীগে অনেক মেধাবী রাজনীতিকবর্গ ছিলেন, কিন্তু নেতৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। এর প্রধান কারণ হল, তাঁর বলার ধরন ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার সুসমন্বয়ে তিনি অবিসংবাদিত সত্তায় উপনীত হয়েছিলেন।
হালে মন খারাপ হয়। এখানে বিরোধী রাজনৈতিক শিবির রয়েছে। কিন্তু, তাঁদের রাজনীতি, তাঁদের বলার ধরন, যুক্তিহীন বক্তব্য, মিথ্যে বলার কায়দা, গুজব ছড়ানোর অভিনব দিক- সব মিলিয়ে মনেই হয়, ওরা কোনদিন জনগণের দল হতে পারলো না!
আবার অন্যদিকে কারণে অকারণে কথা বলে আলোচিত বা সমালোচিত হওয়া লোকগুলোও আমাদের রাজনীতির মানকে ছোট করে ফেলছে। এতে করে দেশের শিক্ষিত সমাজ তাঁদের কথা শুনে মনকে কৌতুকপ্রিয় করে রাজনীতির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন করছে। এই সুযোগটি আমরাই করে দিচ্ছি কিনা! এমনটি চলতে থাকলে ভবিষ্যতের মেধাবী প্রজন্ম আর রাজনীতিতে আসতে চাইবে না।
আমাদের দলের কথাও ধরা যাক। দলের চার পাঁচ জন ব্যতীত জাতীয় রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে কথা বলার লোক কম। আবার অন্য কোন রাজনৈতিক বলয়ে তেমন কোন বড় রাজনৈতিক চরিত্র না আসার দরুণ কার্যত বাকযুদ্ধের প্রয়োজনও পড়ছে না। তবে, প্রস্তুত থাকতেও হবে। কেউ তো অসাধারণ হয়ে জন্মায় না। সাধারণ ঘরে জন্ম নিয়েই কোন এক পরিবার থেকে অসাধারণ নেতা বাংলাদেশে বের হলেও হতে পারে।
আমি তো মনে করি, বিশ্বসেরা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তেমন নেতার একটি রাজনৈতিক দলকে প্রত্যাশাও করে। অর্থাৎ খোদ শেখ হাসিনাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত নেতা আসুক। এর মধ্যেই রাজনীতির সৌন্দর্য শুধু নয়, গণতান্ত্রিক মহড়ার পথও মসৃণ হয়। কিন্তু, যাদেরকে দেখি এদের তো কাউকেই রাজনীতিক বলা যায় না। গোষ্ঠিগত পর্যায়ের বিবেচনায় তাঁরা কী রাজনৈতিক দল হতে পারছে?
গবেষণা দাবি করে, এই দেশের কোন নব্য উদ্ভুত আলোচনার পরিণতি একজন শেখ হাসিনার কাছে। যখন তিনি নিজে মুখ খোলেন, সমাধানের রঙ তার গন্তব্য খুঁজে নেয়। এখানেই তার সফলতা। শুধু চেয়ার আঁকড়ে থাকলে তো হবে না, মানুষ চায় যে, সংকট, সম্ভাবনা ও বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে শীর্ষ রাজনীতিকেরা কী বলছে! অথচ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় মানুষ এখন শুধু শেখ হাসিনায় আস্থা ও বিশ্বাস খোঁজে। কিন্তু এই সংখ্যাটি বাড়ারও দরকার। এতে করে রাজনীতি জিতে যায়।
প্রাসঙ্গিক আলোচনার প্রাণবন্ত উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই যে, মানুষ কী বিএনপিকে বিশ্বাস করে এখন? মির্জা ফখরুলদের অলিক কল্পনায় মন সঁপে দেয়ার জায়গায় সত্যিকার অবস্থায় কি দেশের জনগণ আছে? তাঁদেরকে বিন্দুমাত্র আস্থায় নেয় না মানুষ। তাঁরা জানেই যে, শুধু ক্ষমতার গদিতে বসবার জন্য তাঁরা নানা ছলাকলার আশ্রয়ে এগোতে চাইছে। কাজেই এই রাজনৈতিক অপশক্তির সাথে আবার কিসের বাগযুদ্ধ? হ্যাঁ, মহান জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের প্রচলিত ধারায় বাগযুদ্ধ হয় বা হতে থাকবে, কিন্তু সেখানে অবশ্যই আমরা মেধাবী রাজনীতিকদেরকে প্রত্যাশা করি।
বাগযুদ্ধ, রাজনীতির একটি কাঙ্ক্ষিত রুপ, যা মৌখিক ধারাভাষ্যের প্রকটিত শ্লেষ, অতি অবশ্যই তা রাজনৈতিকভাবে বিদগ্ধজনদের প্রধান খোরাক- বাংলাদেশি এক দার্শনিক এমন করেই বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা শেখ হাসিনা ও গুটি কয়েক রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা বাদ দিলে কোন অন্ধকারকে সঙ্গী করে ফেলেছি কিনা? আমার মনে হয়, আমাদের সকলকে একটু নতুন করে ভাবতে হবে।
আত্মসমালোচনায় ঋদ্ধ হয়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার শর্ত পূরণ করে ঝালিয়ে নেয়া যাক। নতুবা, যেভাবে যাদেরকে দেখছি, এতে করে আমাদের সামাজিক মর্যাদাও হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
লেখক: সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এইচআর/এমএস