ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমার বইমেলা

মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর যত্নে গড়া ঘরটি ভেঙে ফেলছে

কাজী জহিরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আমার ধারণা বাঙালি লেখকরা একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। তাদের আবেগের একটি প্রধান জায়গা হচ্ছে একুশের বইমেলা। যে কারণে ধীরে ধীরে প্রকাশনা শিল্পটি পুরোপুরিই বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের লেখকদের দুটো ঋতু, একটি ঈদ সংখ্যা ঋতু, অন্যটি বইমেলা ঋতু। এই দুই ঋতু ছাড়া তাদের আর কোনো সময়ে সরব হতে দেখা যায় না।

বইমেলা নিয়ে আমার সুখস্মৃতি খুব কম। শুরুটা ছিল বিষাদময়, যখন মেলা আমার কাছে আনন্দময় হয়ে ওঠার সময় তখন আমি দেশের বাইরে। শুরুর গল্পটা বলি। এই গল্প সম্ভবত কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছি।

১৯৯১ সালের কথা। শাহজাদা আনওয়ার নামের এক যুবক আমাকে প্রস্তাব দিলো আমার গল্পের বই বের করে দেবে। বইটি বেরুবে কাকলী প্রকাশনী থেকে। তিনি আমাকে জানালেন বই বের করতে ১০ হাজার টাকা লাগবে। তখন আমার পক্ষে এই পরিমাণ টাকা জোগাড় করা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু তীব্র আবেগের কাছে কঠিন বাস্তবের পরাজয় ঘটলো।

আমি টাকা জোগাড় করে তার হাতে তুলে দিলাম। মেলার প্রথম দিন আমার বই মেলায় উঠে যাবে। আমি বাড্ডা থেকে ৬ নম্বর বাসে চড়ে ফার্মগেট যাই, সেখান থেকে আরেক বাসে শাহবাগ, সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে বইমেলা। সারা মেলা ঘুরে কাকলীর স্টল খুঁজে বের করি। ডিসপ্লের সব বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। কিন্তু আমার বইটি কোথাও দেখি না। সেদিন আর কাউকে জিজ্ঞেস করলাম না। বাড়ি ফিরে গেলাম।

পরদিন ভোরেই শাহজাদার বাড়িতে হানা দিই। শাহজাদা খুব ঠান্ডা গলায়, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, আমি তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, প্রেসে একটু ঝামেলা হয়েছে, বইটা দুদিন পরে মেলায় যাবে। শাহজাদা আমাকে একটা তারিখ দেয়, আমি সেই তারিখে মেলায় যাই। না, সেদিনও আমার বই আসেনি। এভাবে সে আমাকে অনেকগুলো তারিখ দেয়। শেষ পর্যন্ত বইমেলা শেষ হয়ে গেলো।

আমি শেষদিন রাতের বেলা মেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম স্টলগুলো ভাঙা হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল ওরা আমার বুকের ভেতর অনেক যত্নে গড়া ঘরটি ভেঙে ফেলছে। রাগে, অভিমানে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে ছিলাম। পরে একদিন কিছু মাস্তান বন্ধু নিয়ে শাহজাদার বাড়িতে হানা দিই। সে টাকা ফেরত দেওয়ার একটা তারিখ দেয় কিন্তু সেই তারিখে সে টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়।

এরই মধ্যে আমি জেনে যাই ছেলেটি ফেনসিডিল আসক্ত, কিছু কাজ সে করিয়েছে, তবে বেশিরভাগ টাকাই সে নেশায় উড়িয়েছে। পরে ওর কথামতো ফকিরাপুলের এক প্রেস থেকে বইয়ের প্লেটগুলো উদ্ধার করে অন্য এক প্রেস থেকে বইটা সাংবাদিক দুলাল খানের সহযোগিতা নিয়ে ছাপাই। কিন্তু যেহেতু বইমেলা চলে গেছে এই বই নিয়ে আমার মধ্যে আর কোনো উচ্ছ্বাস তৈরি হয়নি।

এরও কয়েক বছর আগে আমি একটি কবিতার বই কিনতে বইমেলায় যাই। সেই বইটি ছিল কবি শামসুর রাহমানের ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’। সেটিই ছিল আমার প্রথম বইমেলায় যাওয়া।

এখন প্রতি বছর আমার অনেকগুলো বই বের হয়। অনেক ভক্ত অনুরাগী পাঠক তৈরি হয়েছে। তারা চায় আমি সই করে তাদের হাতে বই তুলে দিই কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি তা করতে পারি না। ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে দীর্ঘ ১৪ বছর পরে আমি একুশের বইমেলায় গিয়েছিলাম।

ভালো লেগেছে বটে কিন্তু যে বইমেলাকে আমি রেখে এসেছি এটা তো সেই বইমেলা নয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল বইমেলা। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এই বিশাল সমুদ্রে আমি হারিয়ে যাব। মেলার স্টলগুলোর মাথার ওপরে, প্যাভিলিয়নগুলোর মাথার ওপরে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মতো উঠতি লেখকদের বিশাল বিশাল ছবি। কাউকে কাউকে চিনতে পারলাম, যাদের লেখা এখনো বেশ সাব-স্ট্যান্ডার্ড, এখনো যেগুলোকে লেখা বলেই বিবেচনা করা যায় না, তাদেরও বিশাল বিশাল সব ছবি।

বেশ রুচিহীন একটি ব্যাপার। দেশে থাকতে আমার যখন ৭/৮টা বই বেরিয়েছে তখনও আশা করিনি আমার ছবি তো দূরের কথা, আমার বইয়ের ছবিটা স্টলের দেওয়ালে উঠুক। তখন বইয়ের পোস্টার স্টলের দেওয়ালে উঠতো কিছু জনপ্রিয় লেখকের, যেমন- হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন। দেওয়ালে বইয়ের প্রচ্ছদ উঠতো বিখ্যাত কবিদের, যেমন- শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ।

আজকাল দেখি প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে, কবিতা পদবাচ্য কিছুই হয়ে ওঠেনি, তারও বিশাল ছবি প্যাভিলিয়নের মাথার ওপর। মেলার পরিসর বেড়েছে বটে কিন্তু একটুও বাড়েনি মান এবং রুচি।

নিয়ন্ত্রণ শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু কোনো একটা উপায় নিশ্চয়ই আমাদের বের করতে হবে, যাতে মেলায় একটা জ্ঞানের আবহ তৈরি হয়, ভালো গ্রন্থের সমাবেশ ঘটে, প্রকৃত লেখকরা মর্যাদা পান। বইমেলা থেকে সিনেমার আবহ দূর হোক এটা আমার ব্যক্তিগত চাওয়া। হয়তো আজকের বাজারে আমার এই চাওয়ার কোনো মূল্য নেই, হয়তো আমাকে আজকের প্রজন্ম আউটডেটেড ভাবতে পারেন। তা ভাবুন, আমি তো আমার কথাই বলবো।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।

লেখক: সাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/এমএস