ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চীন-জাপানের জনসংখ্যাগত পরিবর্তন

যে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ

কামাল উদ্দিন মজুমদার | প্রকাশিত: ০৯:৪৩ এএম, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কামাল উদ্দিন মজুমদার

চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যা ১৪১ কোটি। চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে গত ১০ বছরে গড় বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ।

এর আগের ১০ বছর ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৯ সাল নাগাদ চীনের জনসংখ্যা ১৪৪ কোটি ২০ লাখে পৌঁছাবে। পরের বছর থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অনবরত কমতে থাকবে এ জনসংখ্যার হার।

চীনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চালু থাকা ‘এক সন্তান নীতি’। পাশাপাশি শিক্ষার আকাশ ছোঁয়া ব্যয়ের কারণেও একটির বেশি সন্তান নেননি অনেক নাগরিক। এমনকি কেউ কেউ কোনো সন্তানই নেননি। ২০১৬ সালে চীনা সরকার বিতর্কিত এক সন্তান নীতিমালার বিপরীতে দম্পতিদের দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেয়। ফলে, পরের দুই বছর জন্মহার বাড়লেও দেশটির জন্ম হারের যে নিম্নমুখিতা তা পাল্টে দেওয়া যায়নি। চীনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে এ বছরই ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীনের প্রতিবেশী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়ও এই সমস্যাটি তীব্র আকার ধারণ করেছে। দম্পতিদের আরও বেশি সন্তান নিতে সরকার নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এরপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওই দুই দেশে জন্মহার কমেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে গত বছর প্রথমবারের মতো জন্মের চেয়ে বেশি মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে।

ফলে বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, জাপানে মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। ২০২২ সালে সেখানে আট লাখের কম শিশুর জন্ম হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকেও দেশটিতে বছরে ২০ লাখের বেশি শিশুর জন্ম হতো। জাপানে জন্মহার ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারে এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে দেশটির সমাজব্যবস্থা অচল হয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এসব দেশে গড় আয়ু বেড়েছে, তবে কমেছে জন্মহার। ফলে সমাজে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাদের সেবা দেওয়ার জন্য তরুণ কর্মীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ৬৫ বা তার বেশি বয়সের জনসংখ্যার দিক দিয়ে জাপান এখন বিশ্বে দ্বিতীয় নম্বরে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে।

চীনের সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১০ সালে চীনে নির্ভরশীল মানুষের হার ছিল ৩৭ দশমিক ১২। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৪৪ দশমিক ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, চীনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা চলতি শতকে ৬০ শতাংশের বেশি কমবে। কাজেই শ্রমশক্তির পড়ন্ত অবস্থা ও বয়োবৃদ্ধ জনসংখ্যা সামাল দিতে অবশ্যই নতুন নীতিগ্রহণ করতে হবে এসব দেশকে।

যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্যই বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, একটি দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে আসার অর্থ হলো শ্রমের দাম বেড়ে যাওয়া। এতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য ও সেবার দাম। তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, দীর্ঘসময় ধরে জনসংখ্যা পড়তির দিকে থাকলে, বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ সংখ্যা যদি একসময় বাড়তে থাকে, তবে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করে। চীনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়তে পারে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা
দীর্ঘদিন ধরেই চীনকে ‘বিশ্বের কারখানা’ বলা হয়। শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য উৎপাদনে চীনের শ্রমবাজার ব্যবহার করে আসছে। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চীনের শ্রমবাজার থেকে সরে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চীনের জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে এশিয়ার অন্যান্য দেশ ও লাতিন আমেরিকা।

তাই, চীনের সঙ্কুচিত জনসংখ্যা থেকে উপকৃত হওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। চীনের কর্মশক্তি হ্রাস পাওয়ায় দেশটি শ্রম-নিবিড় শিল্প থেকে মূলধন-নিবিড় শিল্পে স্থানান্তরিত হবে। স্বল্প-দক্ষ শ্রমঘন শিল্প বাংলাদেশের মতো দেশে স্থানান্তরিত হতে পারে। তখন চামড়া ও তৈরি পোশাকের মতো শিল্প চীনে উদপাদন লাভজনক নাও হতে পারে এবং বিশ্ববাজারে এসব ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমে যাবে। এছাড়া, চীনে বাংলাদেশের আরও রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক হলো, অন্যান্য দেশ থেকে বিনিয়োগ চীনের পরিবর্তে বাংলাদেশে আসবে।

পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রেকর্ড ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে এবং ২০২১ সালের তুলনায় পোশাক রপ্তানি ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ডেনিমের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন প্রথম স্থানে। ইউরোপের বাজারেও চীনকে হটিয়ে একনম্বর স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। পরিবেশগত কারণে টেক্সটাইল থেকে সরে যাচ্ছে চীন।

ফলে বাংলাদেশের জন্য ভালো একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীন থেকে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রয়াদেশ এসেছে বাংলাদেশে। আগামী বছরগুলোতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক শিল্প খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে পোশাক উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিজিএমইএ।

জাপান এর সরকারি থিংক ট্যাংক গ্রুপের অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে সরকার ঘোষিত অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশটিতে প্রায় ৬৭ লাখ ৪০ হাজারের অভিবাসী কর্মীর প্রয়োজন হবে। বর্তমানে জাপানে প্রায় ১.৭২ মিলিয়ন প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ০.০২ শতাংশ। দেশটির অধিকাংশ কর্মী আসে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে।

জাপান সরকার বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ যেমন- নেপাল, ভারত, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার থেকেও কর্মী নিতে আগ্রহী। ২০১৯ সালে দেশটিতে কারিগরি ও প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ১৪টি নির্দিষ্ট খাতে ৫ বছরে সাড়ে তিন লাখ বিশেষায়িত দক্ষ কর্মী নেবে জাপান।

জাপানের মানুষের গড় আয়ু বেশি এবং জন্ম হার কম হওয়ায় দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পেয়ে বেড়েছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী, এতে অধিক বয়সী মানুষের সেবার জন্য কেয়ার গিভারের প্রয়োজন বাড়ছে দেশটিতে। ফলে বাংলাদেশের নারী শ্রমিক প্রেরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজার হতে পারে জাপান। এ বিশাল সম্ভাবনাময় জনশক্তি বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরিতে দ্রুত ও পরিকল্পিত প্রস্তুতি নিতে হবে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম তরুণ, যারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্টের এই সুযোগ কাজে লাগানো ও বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে চীন ও জাপানের বাজারে। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার আধুনিকীকরণ, সরকারি-বেসরকারি খাতের উপযুক্ত সমন্বয় ও সফল কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সুযোগ গ্রহণ করা উচিত।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস