সচেতনতার মাধ্যমে ক্যান্সার ঠেকানো সম্ভব
আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। পৃথিবীতে বছরে যে কত দিবস পালিত হয় তা সম্ভবত সবচেয়ে ভালো জানেন বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থীরা। গত শতাব্দীতে আমি যখন বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাটি দিয়েছিলাম তখন সম্ভবত শর কাছাকাছি দিবসের নাম আর তারিখ মুখস্থ করতে হয়েছিল। আর এখন আমার ধারণা তা অনায়াসে কয়েক শ ছাড়িয়ে যাবে।
এত সব দিবসের ভিড়ে আজকের এই দিনটি নিয়ে আলাদা করে লেখার গুরুত্বটা অন্যখানে। একসময় বলতে গেলে যে ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসা ছিল না, সেই ক্যান্সার চিকিৎসায় সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। এখন এমন অনেক ক্যান্সারই আছে, সময়মতো ধরা পড়লে যেগুলো পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য। কাজেই সময়মতো ধরতে পারাটা আজকের ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
আমি যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সেখান থেকেই উদাহরণটা দিতে পারি। আজকের দিনে যদি কারো লিভারে ক্যান্সার হয়, আর তা যদি শুরুতেই ধরা পড়ে, তবে তার জন্য রয়েছে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাব্লেশন বা আরএফএ আর ট্রান্সআর্টারিয়াল কেমো-অ্যাম্বোলাইজেশনের মতো আধুনিক সব চিকিৎসাপদ্ধতি। সঙ্গে লিভার রিসেকশন কিংবা ট্রান্সপ্লান্টেশনের কথা না হয় না-ই বললাম। এসব চিকিৎসাপদ্ধতি আজকের বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে আমাদের দেশেও আমরা বহু লিভার ক্যান্সারের রোগীকে পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারছি।
পাশাপাশি এসেছে নতুন ধরনের ওষুধও। এত দিন আমরা ক্যান্সারের চিকিৎসায় শুধু কেমোথেরাপি আর রেডিওথেরাপির কথাই শুনে ও বলে এসেছি। কিন্তু এখন আমাদের হাতে আছে বাড়তি অস্ত্র ইমিউনথেরাপি, যা দিয়ে আমরা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে আরো সতেজ করে নানা ক্যান্সার নির্মূল করতে পারি।
যেমন—লিভার ক্যান্সারের জন্য আমাদের হাতে আছে অ্যাটেজলিজুমাভ, বেভাসিজুমাভ আর নিবোলুমাভ। এসব ওষুধ যে শুধু বাংলাদেশে পাওয়াই যায় তা-ই নয়, এর কোনো কোনোটা তৈরি হচ্ছে খোদ বাংলাদেশেই। ফলে লিভার ক্যান্সারের রোগীদের সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রেও সঞ্চার হচ্ছে নতুন আশার, যেমনটি হচ্ছে আর দশটি ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও।
বিশ্ব ক্যান্সার দিবসটি বিশ্বব্যাপী উদযাপনের আরেকটি বড় লক্ষ্য, ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি। কারণ মানুষ যদি সচেতন হয় তাতে যে শুধু ক্যান্সার আরো আগেভাগে শনাক্ত হয় তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই শুধু সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা ক্যান্সারকে ঠেকিয়েও দিতে পারি।
আবারও লিভারেই ফিরে যাই। বাংলাদেশে লিভার ক্যান্সারের প্রথম দুটি কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ফ্যাটি লিভার। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক যে মানুষেরা ছোটবেলায় ইপিআই টিকা পাননি তাঁদের টিকা নেওয়ায় সচেতন করে, পাশাপাশি মানুষের জীবনাচারের পরিবর্তন করে আমরা হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ফ্যাটি লিভারজনিত লিভার ক্যান্সার ঠেকিয়ে দিতে পারি।
আর জীবনাচারের পরিবর্তন শব্দটা যতটা গালভরা বিষয়, কিন্তু ততটা জটিল নয়। যদিও এ কথাও সত্যি যে পরিবর্তিত জীবনধারা, অর্থাৎ রাতে খাওয়া আর ঘুমের মাঝখানে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা গ্যাপ দেওয়া, গরু-খাসির মাংসের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় শর্করা যেমন চা-কফিতে চিনি আর বাড়তি মিষ্টি বর্জন করা, আর সপ্তাহে পাঁচটা দিন আধাঘণ্টা করে হাঁটাহাঁটিতে অভ্যস্ত হওয়াটা অত সোজা কাজ নয়।
এবারের বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্যটা অবশ্য একটু অন্য ধরনের। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’। অর্থাৎ এ বছর জোর দেওয়া হচ্ছে ক্যান্সার চিকিৎসাগ্রহীতা আর ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীর মধ্যকার ব্যবধানটা ঘুচিয়ে আনার ওপর।
সাম্প্রতিক সময়ে যাঁদের বিমানে চেন্নাই যাওয়া-আসার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই যাওয়া এবং আসার পথে হুইলচেয়ার আরোহী বেশ কিছু সহযাত্রী পেয়েছেন। খেয়াল করে থাকলে তাঁরা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে এই মানুষেরা বিষণ্নচিত্তে বাড়তি কিছুর প্রত্যাশায় হুইলচেয়ারে বিমানে চাপছেন আর তাঁরা যখন দেশে ফিরছেন আবারও সেই হুইলচেয়ারে চেপেই, তাঁদের বেশির ভাগেরই চোখেমুখে বিষণ্ণতার জায়গায় খুশির পরশ।
বিষয়টি সম্ভবত চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এর যোগাযোগটা সন্তুষ্টির সঙ্গে। হেলথ মাইগ্রেশন কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। আমরা যখন চিকিৎসা নিতে কলকাতায় যাই তখন ওই কলকাতার লোকেরাই ছোটে আরেকটু ভালোর খোঁজে চেন্নাইয়ে। আর আমরা দু্ই বাংলার বাঙালি চেন্নাইয়ের যে হাসপাতালগুলোয় ভিড় জমাই, সেখানকার অনেক রোগী কিন্তু চাপে দিল্লি কিংবা মুম্বাইমুখী বিমানে। তবে আমাদের দেশ থেকে যে পরিমাণ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী, সেই প্রবণতাটা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক।
রোগীর আধুনিক চিকিৎসা আমরা ঠিকঠাকমতো নিশ্চিত করছি, কিন্তু অর্জন করতে পারছি না রোগীর সন্তুষ্টি। ক্যান্সার কেয়ারের এই যে গ্যাপ, এটি কমিয়ে আনাই এবারের বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্য। এ সমস্যা বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বময়। আর তাই এই প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশ ছাড়াও প্রযোজ্য বিশ্বব্যাপী। তবে বিশ্বের স্বাস্থ্য খাত আমাদের দায়িত্বে নয়, আমাদের বুঝতে হবে আমাদের রোগীর ভালো।
আর সে কারণেই খুঁজতে হবে ব্যবধানের কারণগুলো। এর অনেক কারণই আমার মাথায় আছে, আবার অনেকটি হয়তো আমি ভাবনায়ও আনছি না। আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত প্রায় পুরোটাই সরকারি স্বাস্থ্যসেবকদের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই এ দেশে যাঁরা ক্যান্সার চিকিৎসার মতো বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা প্রত্যেকেই ওভারটাইমের ভারে ভারাক্রান্ত। আছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতাও, যেমন স্বল্পতা আছে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেরও। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের বাইরে, বিশেষ করে মফস্বলে এই বাস্তবতাগুলো অনেক বেশি প্রযোজ্য। যেমন— আরেকটি বাস্তবতা এই যে আমাদের রোগীরা ভিনদেশি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার সমতুল্য সেবা পেতে চায় রোগীর চাপে জর্জরিত আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে।
সমস্যা হয়তো আছে এমনি আরো অনেক। সমস্যা তা যত যাই-ই আর যত বেশিই হোক না কেন, তার সমাধানও থাকতেই হবে। আর আমাদের নিজেদের তাগিদেই সেগুলো চিহ্নিত করে সেসবের সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আমরা ডিজিটাল যুগকে পেছনে ফেলে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগোচ্ছি। আর স্মার্ট বাংলাদেশে কেয়ারের এই গ্যাপ কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাহলে যে দেশটা স্মার্টই হবে না।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/জেআইএম