নির্বাচনী হতাশা মস্ত রাজনৈতিক ফাঁদ
বিএনপির এমপিদের পদত্যাগে শূন্য হওয়া ছয়টি সংসদীয় আসনে নতুন জনপ্রতিনিধি ঠিক হলো গত বুধবার। ছয়টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া, বিএনপি ছেড়ে আসা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া।
বাকিগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ এবং বগুড়া-৬ আসন গেলো আওয়ামী লীগের ঘরে। বগুড়া-৪ আসনে জিতেছেন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রার্থী। আওয়ামী লীগের সমর্থন পেলেও ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জিততে পারেননি ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী। এখানে জয়ের দেখা পেয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী।
একটি নির্বাচন হয়ে গেলো, সংসদে যাওয়ার জন্য ছয়জন ব্যক্তিও ঠিক হয়ে গেলেন, কিন্তু কেমন নির্বাচন হয়েছে সেটি এখন আর ভাবার বিষয় নয়। নির্বাচন কমিশন অনুমান করছে যে, এই উপ-নির্বাচনে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এটাও বড় অংকই বলতে হবে, কারণ এর চেয়ে কম ভোটে উপ-নির্বাচন সম্পন্নের নজিরও বেশিদিন আগের নয়।
উকিল আবদুস সাত্তার আলোচিত হয়েছেন বেশ কয়েকটি কারণে। প্রথমত তিনি দলের সিদ্ধান্তে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আবার নির্বাচন করেছেন এবং তার সমর্থনে শাসক দল আওয়ামী লীগ প্রার্থীই দেয়নি। উপরস্তু এই আসনের একজন প্রার্থীর নিখোঁজ হওয়া বড় খবর হয়ে থাকলো পুরো সময়টায়। বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনও আলোচনায় ছিল আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের কারণে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বগুড়া-৪ আসনে ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন তিনি। তবে জামানত হারাতে যাচ্ছেন বগুড়া-৬ আসনে।
ফেসবুক আর ইউটিউবে এখনও আলোচনা হিরো আলমের পক্ষে বিপক্ষে। একটা বড় অংশই মনে করে বাংলাদেশের রাজনীতির যে মান এখন, সেখানে হিরো আলমদেরই মানায় এবং তাকে নিয়ে ট্রল করার কিছু নেই। এই যে, নির্বাচন নিয়ে এমন হতাশা সেটি এক এক মহা রাজনৈতিক ফাঁদ।
জাতীয় সংসদের কোন আসনের উপ-নির্বাচন হোক বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন- সব ক্ষেত্রেই কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। শক্ত কোন বিরোধী পক্ষ নেই, তাই শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যেই মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা থাকে ও দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কোনোভাবেই বাড়ছে না এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তির কাছে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশিত।
জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে এই উপ-নির্বাচন সত্যি আলাদা করে দেখার প্রয়োজন আছে কি না, সেটিও রাজনৈতিক জায়গা থেকে ভাবা দরকার। যদি এরকম নির্বাচন হতে থাকে, তাহলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে আসবে যে, ভোটে জেতার জন্য ভালো কাজ করার আর দরকার হবে না।
ভোটারদের হৃদয় জয়ের চাইতে সরকারদলীয় মনোনয়ন বাগানোটাই বড় কৃতিত্ব হতে চলেছে প্রার্থীদের কাছে। কোন নেতা সৎ, কোন নেতা কত দুর্নীতিগ্রস্ত, সে বিষয়ে মতামত সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন এখন দলও চিন্তা করে বলে মনে হয় না।
মানুষের সাথে রাজনীতির সংযোগ গণতন্ত্রের একটি প্রধান দিক। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এখন সেই সংযোগ থেকে দূরে থেকে ভিন্ন যোগাযোগকে বড় করে নিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণেতা হিসেবে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে আগ্রহী না হলেও উন্নয়নের নামে ঠিকাদারি কাজে মন থাকে ঠিকই।
সেই উন্নয়নকাজ কে ভালো করছেন, কে কোন খাতে খরচ করছেন, তার হিসাবটা স্বচ্ছভাবে পেলে রাজনীতির মাঠে মানুষের আগ্রহ জন্মায়। তাতে ভোটদাতা রাজনীতির সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত হন। নাগরিকের সতর্কতা যত বাড়ে, গণতন্ত্র তত ফলপ্রসূ হয়।
একটা সময় ছিল যে কোনো ছুতোয় খুনখারাপির বাতাবরণ তৈরি করা। সেটি এখনও আছে। তবে এর সাথে প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বা একতরফা নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা। এর কারণে পুরো ব্যবস্থার ওপর জনঅনাস্থা তৈরি করা হচ্ছে। নেতায় নেতায় পার্থক্য অবশ্যই আছে তবে, সেই পার্থক্যের বিচার নির্বাচনে গুরুত্ব পাচ্ছে কম।
রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রমুখিতা বড় বেশি। শীর্ষ নেতারা যা বলবেন, তার বাইরে আর কোনো কথা নেই। কে কেমন কাজ করছেন, তার গুরুত্ব সামান্য। ফলে জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি নির্বাচন অধরা হয়ে যাচ্ছে। তাই কী নির্বাচন হলো, আর কেমন নির্বাচন চলো, সেটি নিয়ে মিডিয়া উচ্চকণ্ঠ হলেও মানুষের আগ্রহ তেমন নেই।
কী করলে রাজনৈতিক দলের কাছে প্রার্থী মনোনয়নের সময়ে মানুষের সাথে সংযোগ আর সমাজের প্রতি অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে চিন্তা দরকার। আর সেই সাথে খোদ রাজনীতি নিয়েই ভাবনা দরকার। কেন রাজনীতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছলো যে, যেকোনো প্রার্থী যেকোনো উপায়ে মনোনয়নপ্রেমী হয়ে উঠছেন মানুষের নেতা হতে না চেয়ে? অবস্থা না বদলালে নির্বাচন হতে থাকবে ঠিকই, তবে মানুষের জন্য কাজ করার যে নির্বাচনী রাজনীতি সেটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আর এটি যত ঘটবে গণতন্ত্র ততই নিষ্ফল হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এএসএম