ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমার বইমেলা

বই পড়ো সই

শান্তনু চৌধুরী | প্রকাশিত: ১০:২৬ এএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ছেলেবেলায় আমরা মেলা বলতে বুঝতাম গ্রামীণ জীবনে সে নানাবাড়ি বা দাদাবাড়িতে পূজার সময় নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুলনাচ আর নানা খাবার দোকান দিয়ে সাজানো একটা জমায়েত! খেলনা দোকান আর চা জিলিপি অন্যতম অনুষঙ্গ। এর পাশে নিতান্ত অবহেলায় পড়ে থাকে কয়েকটি বই সেগুলো মূলত কোনো ধর্মীয় বই, লক্ষ্ণীর পাঁচালি আর রাক্ষস খোক্ষসের গল্প। সেখানে বইমেলা ব্যাপারটা কী! সেখানেও কি সার্কাস বসে?

সিংহ গর্জন করে? মরণকূপ কাঁপিয়ে মোটরসাইকেল পাক মারে গোঙাতে গোঙাতে! এসব চিন্তা তখনো ভর করেনি। কারণ ডুবে আছি রাজপুত্রের উদ্ধার অভিযানে। টানটান উত্তেজনা। এই বুঝি রাক্ষস এসে খেয়ে ফেলবে। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি দিয়ে জাগানো যাবে না রাজকন্যাকে।

বইমেলা বিষয়টা প্রথম এলো ঢাকায় যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়তে এলাম। কলেজ শেষে প্রায় দিন যেতাম বাংলা একাডেমিতে। তখনো বইমেলার পেট এতোটা ফুলেনি। সীমাবদ্ধ ছিল বাংলা একাডেমির ওই চত্বরে। ততোদিনে পত্রিকার সাথে জড়িয়ে গেছি। এবং পড়ুয়াদের সঙ্গ যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে সেটা ওই পত্রিকা অফিসে গিয়েই বুঝেছিলাম। কিন্তু প্রায় প্রায় বইমেলায় গেলেও নতুন নতুন বই উল্টে পাল্টে দেখতাম।

বই কেনা হতো কম। কারণ দাম একটা বিষয়। তাই বই পড়া হতো মূলত ধার করে। আর সংগ্রহ হতো ফেরত না দিয়ে! এর মধ্যে একদিন বইমেলায় হুমায়ূন আজাদকে দেখে সাহস করে কিনে ফেললাম ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ বইটি। সঙ্গে ছিল বন্ধু মিলন। সেলফির যুগ তখনো আসেনি। বন্ধু পরামর্শ দিল একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য।

তখন উনার অটোগ্রাফ নিতে অনেকে দাঁড়িয়েছেন। আমি সাহস করতে পারছি না। বইটি নিয়ে মেলায় ঘুরছি। এদিকে বাসায় ফেরার তাড়া। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। চলে আসবো এমন সময় দেখি উনি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সাহস করে বললাম ‘একটা অটোগ্রাফ দেন’।

জানতে চাইলেন উনার আর কোনো বই পড়েছি কি না? আমি ‘না’ জবাব দিলাম। আমার চেহেরার দিকে তাকিয়ে উনি অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন। সেই একটি বই পড়ার পরতো উনার বাকি বইও পড়া হয়েছে ধীরে ধীরে।

আমি সবসময় বলি যারা আমাকে খাওয়ার দাওয়াত দেন বা কিছু গিফট দিতে চান তারা যেন বই উপহার দেন। সেই তরিকায় গেলো কয়েক বছরে বেশ বই উপহার পেয়েছি। আর বই পাওয়ার পর যেটা শুরু হয়, দ্রুত পড়ে ফেলার তাগিদ। অনেকটা গরম গরম জিলাপির মতো। মচমচে থাকতে খেতেই বুঝি স্বাদ। যদিও বইয়ের বিষয়টা তেমন নয়। বই চিরকালই নতুন।

এরপর যখন সাংবাদিক হিসেবে বইমেলায় সংবাদ খুঁজতে যেতাম তখন লক্ষ্য ছিল বইয়ের পাশাপাশি লেখকদের সঙ্গে কথা বলার। তেমন কিছু কথা মনে পড়ছে। যেমন সৈয়দ শামসুল হক কেন তরুণ হয়ে চলাফেরা করতেন। বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের সাথে কথা বলা বেশ মুশকিল ছিল।

এতো এতো লোকজন তাকে ঘিরে থাকতো। এখন যেমন থাকে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। একদিন চলে গেলাম তার ধানমন্ডির ‘দখিনা হাওয়া’তে। সময় দিলেন দশ মিনিট। আলাপ গড়ালো এক ঘণ্টায়। যখন গিয়েছিলাম তিনি চুলে কালো রং করছিলেন। কেন?

‘আমি অল্প বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। তার সামনে পাকা চুল নিয়ে ঘুরতে ভালো লাগে না। এ কারণে চুলে কলপ লাগাই। রংচঙা শার্ট পরি। বয়স কমিয়ে ফেলার হাস্যকর প্রচেষ্টা আর কী!’ আসার সময় স্বাক্ষর করে উপহার দিলেন ‘আমার আছে জল’ বইটি। ইমদাদুল হক মিলন বেশি লিখেন প্রেমের উপন্যাস কিন্তু তিনিই আমাকে বললেন নিজে প্রেমের উপন্যাস পছন্দ করেন না।

মেলা ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হয় নাসরীন জাহানের সঙ্গে। মেলায় ২৭ দিন পরে আসার জন্য তিনি ২৭টি শাড়ি কেনেন। সেই গল্প বললেন আমাকে। সৈয়দ আবুল মকসুদ কেন সাদা কাপড় পরতেন সেই গল্প, গাছে ওঠা যে আনিসুল হকের ভালো লাগে, চুল বড় রাখার জন্য কবি সমুদ্র গুপ্তকে আঠারোটি স্কুল বদল করতে হয়েছে, সেলিনা হোসেন বলেন, কিছু লেখার জন্য তিনি পরিবেশ দেখেন, মানুষ দেখেন। কোনো বিষয়ে যে আহসান হাবীব সিরিয়াস নন সেই গল্প বলেন তিনি নির্দ্বিধায়।

লুৎফর রহমান রিটন ছড়ার পাশাপাশি নিজেকে চেনাতে চান গোঁফ দিয়ে। এমন কতো কতো গল্প বইমেলাকে ঘিরে। বয়সের ব্যবধান থাকলেও এদের অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুবাৎসল্য। বইমেলায় গেলে দেখা হয়ে যায় কতো বড় বড় মানুষের সাথে। নিজেকে ধন্য মনে হয়। আবার অনেকে হয়তো স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত নেই। কিন্তু তার সৃষ্টি দিয়ে তিনি স্পর্শ করে যান পাঠককে। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর কিংবা আহমদ শরীফ, সেলিম আল দীন এখনো হেঁটে বেড়াচ্ছেন।

একসময় নিজেও লেখালেখি শুরু করলাম। গল্প, উপন্যাস, সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই প্রকাশ হলো। অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ কতো কিছুই হয়। সময় গড়িয়ে যায়, বদলায় সম্পর্কগুলোও। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা রম্য কিছুটা বাস্তবতা নিয়ে লেখা আমার ১৬তম বই ‘সম্পর্কসূত্র’ আসছে এবারের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে।

বইয়ের সাথে সম্পর্কই আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় সম্পর্ক। যে সম্পর্ক কখনো স্বার্থ দেখে না। ছেড়ে যায় না। বইকে যদি সই করে নেওয়া যায় তাহলে সেই অনন্ত যৌবনা সই-ই থাকবে চিরকালের সঙ্গী হয়ে। বইয়ের প্রতি সেই ভালোবাসাই পারে সব অন্ধকার, কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্তি এনে দিতে। তাই বই হোক সঙ্গী।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/এমএস