ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মায়ের নাম লেখার স্বীকৃতি

দরকার সন্তানের পূর্ণ অধিকারের আইন

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

সন্তানের অভিভাবক হিসেবে পিতার জায়গায় পিতৃহীন সন্তানরা লিখতে পারবে মায়ের নাম। এইটুকু স্বীকৃতি আদায় করতে লেগে গেলো ১৪টি বছর প্রকারান্তরে ৫১ বছর। ১৪ বছর আগের একটি ঘটনা। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর বাবার স্বীকৃতি না থাকায় সে রেজিস্ট্রেশনের সময় বাবার নাম লিখতে পারেনি। ফলে তার অ্যাডমিট কার্ড না আসায় পরীক্ষাটাই আর দিতে পারেনি।

পরে পত্রিকায় ঘটনাটি প্রকাশিত হলে কিছু মানবাধিকার সংগঠন পত্রিকার কাটিংসহ রিট করলে সেটি গ্রহণ করে আদালত। এতো বছরের শুনানি শেষে অবশেষে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ এসে সেই স্বীকৃতি দিলেন মহামান্য হাইকোর্ট। রায়টি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিঙ্গেল মায়েদের আবেগী পোস্ট চোখে পড়ছিল। একেকজনের লেখা পড়ছিলাম আর আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলাম।

একজন মা যে নারী ছিড়ে জন্ম দেয় একজন সন্তানের অথচ সেই সন্তানের পরিচয়ে ঠাঁই মেলে না সেই মায়ের। এমন অনেক সন্তানের জন্ম হয় যাদের বাবার পরিচয় আইনগতভাবে সামনে আসে না বা প্রকাশ করা যায় না। আবার যৌনপল্লিতে যেসব সন্তানের জন্ম হয় তারা কি তবে কারও সন্তান নয়? হায়রে আইন। এত বছর পর এসে মামলা করেই তবে আদায় করতে হলো এই অধিকার।

আমাদের দেশের আইনগুলো প্রায় সবই শত বছরের পুরোনো। যে আমলে আইন, আদালতের আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি সেই আমলে মূলত সামাজিক বিধিকেই আইন হিসেবে মানা হতো। ধীরে ধীরে সেগুলোই আইনি কাঠামোতে রূপ পেয়েছে। আর তাই তো সেগুলোর কোনো আধুনিকায়ন আর হয়নি। পারিবারিক বিষয়গুলো এখনও মুসলিম পারিবারিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সন্তানের অভিভাকত্ব বা সন্তানের গার্ডিয়ানশিপ।

আইনে বলা আছে, ছেলেসন্তানের সাত বছর পর্যন্ত আর মেয়েসন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মা চাইলে তার কাছে রাখতে পারবে। এরপর পিতা চাইলেই সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, এই রাখা মানেই অভিভাবকত্ব বা কাস্টোডি পাওয়া নয়। মা হচ্ছে তদারককারি। খুব যদি বাজে ভাষায় বলি তাহলে আইনের চোখে মা হচ্ছে একজন ‘কেয়ারগিভার’।

বা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হলেও মা তার সন্তানকে কেবল একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত দেখভাল করবে অথচ কায়দামতো সময়ে বাবা এসে সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে চলে যেতে পারবে। কী অমানবিক একটি আইন। এই যে সন্তানকে একজন একলা মা কষ্ট করে পেলেপুছে বড় করলো অথচ এর কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই।

বিচ্ছেদের পর অনেক ঘটনায়ই দেখা যায় বাবা তার সন্তানের ভরণপোষণটুকু পর্যন্ত দিতে চায় না বা দেয় না। আইনে বলা হলেও বেশিরভাগই এক্ষেত্রে অবহেলা করে। একজন মা তার নিজের ভরণপোষণের পাশাপাশি সন্তান/সন্তানদেরও বেঁচে থাকার জোগান দেয়। বাবা হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে সন্তানের সাথে দেখা করে যায় বা অনেকে করেও না। দূর থেকেই হয়তো খোঁজ রাখে বা রাখে না।

মানে বিষয়টা পুরোই বাবাদের ইচ্ছার বিষয়। আর পরিবারগুলোও এই বিষয়ে উদাসীনই থাকে। বিচ্ছেদ মানেই একজন নারীর জন্য বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার ইতিহাস। সামাজিক, পারিবারিক, কর্মক্ষেত্র, আইনি প্রায় সবদিকেই তাদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে থাকে। একজন মা কোনোদিন তার সন্তানকে অস্বীকার করতে পারে না। দায়িত্ব অবহেলা করতে পারে না। একজন মা কখনও বাধ্য না হলে চায় না তার সন্তানকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করতে।

আমার পরিবারেও একজন সিঙ্গেল মাদার আছে। আমি কাছ থেকে দেখেছি তার সংগ্রাম। একমাত্র সন্তানকে পাঁচ বছর বয়সে কোলে নিয়ে সংসার ছেড়ে আসা সেই মা একদিকে চাকরি আর অন্যদিকে সন্তানের পড়াশোনা, খরচ, লালনপালন, দেখাশোনা সবকিছুকে ঠিক রাখতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। পারিবারিক সমর্থনও ছিল খুব কম।

হাজব্যান্ড না দিয়েছে সন্তানের ভরণপোষণ, না দিয়েছে স্ত্রীর। অথচ এই নারীটি একা হাতে সবকিছু সামলাতে হয়েছে। সমাজের কূটকর্মকে পাশ কাটিয়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে নিতে হয়েছে। সেই সন্তান এখন উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে আর মা একদম একা জীবন কাটাচ্ছে। মানসিকভাবে ভালো নেই তিনি। সন্তানের মায়ায় নিজের জীবনের সবকিছু বিসর্জন দেওয়া মা এখন পড়ন্ত বেলায় এসে নিজের হিসাবটাই মেলাতে পারছে না। বাস্তবতা একমাত্র সন্তানকে দূরে পাঠিয়েছে অথচ তার কাছে কেউ নেই।

এই যে একজন মায়ের একাকিত্বের লড়াই এ কেবল যার জীবনে ঘটে সেই বোঝে। এমনকি তার পরিবারও বোঝে না কারণ পরিবার কেবল হতাশার কথাই বলতে শেখায়। পাশে থাকার দায়িত্বটা পালনে সবাই সফল হয় না। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি বারবার আবেগী হয়ে পড়ছি কারণ আমিও একজন মা। আমিও আমার সবকিছুর আগে সন্তানের চাহিদাকেই প্রাধান্য দেই। আর সেই মায়েরই সন্তানের ওপর দাবি দেয় না এই সমাজ।

আমি জানি এই প্রত্যাশিত রায়টি অনেকের বুক থেকে হিমালয়কে টেনে নামিয়ে দেবে। অনেক সিঙ্গেল মায়ের মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠবে কারণ এতোদিন তো কাগজে নামটাই লেখার অনুমতি ছিল না। আজ রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতি অনেক পিতৃহীন/পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের লজ্জাবনত অবস্থা থেকে মুক্তি দেবে। তারাও এখন আর মুখ লুকাবে না।

বিনা দ্বিধায় কলম দিয়ে মায়ের নামটাকে লিখে দিয়ে আসবে অভিভাবকের শূন্যস্থানে। খুঁজতে হবে না কে তার পিতা কোথায় তার বাস। তাই সন্তানের কাস্টোডিয়ান হিসেবেও মায়ের স্বীকৃতিটুকু আসুক দ্রুত।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস