রম্য
ভুয়াদের রাজ্যে
খুবই অশান্তিতে আছেন ইব্রাহীম কওকাব। একেবারে কাঁঠালের আঠার মতো পিছনে লেগে আছে অ্যান্টি করাপশনের দুই ঘুঘু। এই মানিক জোড়ের হুমকি-ধামকির মুখে কওকাব প্রথমে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেন। তারপর তার রাতের ঘুম হারাম হলো, ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলো; তিনি নিয়মমাফিক ডায়াবেটিস হাসপাতালে গিয়ে প্রস্রাবের শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা করাতে ভুলে গেলেন।
অথচ কওকাব সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভেবেছিলেন, পূর্ব রামপুরায় চারতলা বাড়িটা কমপ্লিট করার পর পায়ের ওপর পা তুলে অবসর জীবনটা নিরুদ্বেগে, নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিবেন। কিন্তু দুষ্টগ্রহের মতো হঠাৎ উদয় হওয়া এই জুটি তার সব স্বপ্নকে কাচের গ্লাসের মতো আছাড় মেরে ভেঙে দিতে উদ্যত হয়েছে। কওকাব মনে মনে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা গালিগুলোর একটি এবং তৎসঙ্গে পাহাড়-সমুদ্র বিদীর্ণ হয় এমন একটি অভিশাপ ছুড়ে দিলেন তাদের উদ্দেশ্যে।
গালির আকারে অভিনব কিছু শব্দমালা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে অনেকটা আরাম পেলেন ইব্রাহীম কওকাব। কিন্তু এই আরাম অধিকক্ষণ স্থায়ী হলো না। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতেই তিনি দেখলেন, মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে এন্টিকরাপশনের অফিসার আলাল ও জালাল। আলাল ধমকের সুরে কাওকাবকে বলল-
: কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?
পাশ থেকে জালাল বলল-
: ইচ্ছে করেই খুলেনি। আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে মজা দেখছিল।
ইব্রাহীম কাওকাব জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন-
:বিশ্বাস করেন; বিশ্বাস করেন...
আলাল: আপনাকে বিশ্বাস করে দেশ ঠকেছে, দেশের মানুষ ঠকেছে।
জালাল: ইব্রাহীম সাহেব, কাউকে বলে বা জোর করিয়ে বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। আপনার কর্মধারাই আপনি কতোটা বিশ্বাসযোগ্য, তা বলে দেয়।
কাওকাব: আমি আসলে একটু অন্যমনষ্ক ছিলাম; দরজার কলিং বেলটা ঠিকমতো শুনতে পাইনি।
আলাল: অন্যমনষ্ক ছিলেন; কিন্তু কেন? নতুন আরেকটা চারতলা খাড়া করার ধান্দা করছেন না তো?
জালাল: আগেরটা ঝামেলা শেষ করেন। তা না হলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। মাঝখান থেকে জেলে পচে মরতে হবে বাকি জীবন।
কাওকাব: আমি জেলে যাব কেন?
আলাল: জেলে যাবেন কারণ, সামান্য একটা কেরানির চাকরি করে ঢাকা শহরে আপনি চারতলা বাড়ির মালিক হয়েছেন।
জালাল: আপনার আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
কাওকাব: আমার আয়ের সাথে ব্যয় সঙ্গত নয়, কথাটা ঠিক নয়। আমি আয় করেছি বলেই ব্যয় করতে পেরেছি।
আলাল: যুক্তিসঙ্গত কথা। আপনি অবশ্যই আয় করেছেন; তবে সেটা বৈধভাবে নয়। অবৈধ উপায়ে।
আলাল: ফাইল আটকিয়ে, উৎকোচ গ্রহণ করে। আর এজন্যই আপনি আজ আমাদের আপনার সামনে দেখতে পাচ্ছেন। তা না হলে কি আমাদের সাধ্য ছিল...; যাক এসব কথা। এখন ভালোয় ভালোয় আমাদের দাবিগুলো পূরণ করে ফেলুন। দেখবেন, কোনো ঝামেলাই আপনাকে আর স্পর্শ করবে না।
কাওকাব: আপনাদের দাবি মেটাতে হলে তো আমাকে বাড়ি বিক্রি করতে হবে।
আলাল: তাই করছেন না কেন? আপনার শরীরের কোনো একটি অংশে যদি পচন ধরে, তবে তা কেটে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। তা না হলে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে এবং আপনার মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে। তার চেয়ে নির্দিষ্ট ওই অংশটুকু কেটে ফেললে যেমন বাঁচার আশা থাকে, তেমনি বাড়ি বিক্রি করে দিলেও সব ঝামেলা চুকে যায়।
জালাল: অবশ্য ঝামেলা শেষ হওয়ার প্রশ্নটি তখনই চুড়ান্ত রূপ লাভ করবে, যখন আমরা আমাদের পাওনা পুরোপুরিভাবে বুঝে পাব। ইব্রাহীম সাহেব, আর সময় নষ্ট করবেন না, প্লিজ। আমাদের সময়ের দাম আছে। আমরা একবার যদি কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলি, তাহলে কিন্তু আপনাকে পথে বসতে হবে। মামলা-মোকদ্দমা-জেলখানা, আপনার বাকি জীবনটা কী রকম দুর্বিষহ করে তুলবে, তা কি আপনি বুঝতে পারছেন?
কাওকাব: পারছি। আমাকে আপনারা আরও দিন পনের সময় দিন। দেশের বাড়িতে আমার কিছু জমি-জমা আছে, তা বিক্রি করে আমি আপনাদের দাবি মেটাব।
ইব্রাহীম কওকাব তার গ্রামের বাড়ি গেলেন এবং মামার বাড়ির ওয়ারিশ হিসেবে পাওয়া জমিটুকু বিক্রি করে ফেললেন। অ্যান্টিকরাপশনদ্বয় ‘পেমেন্ট’ নেওয়ার জন্য যে তারিখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, তার ঠিক একদিন আগে দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর পড়ে কওকাব যতটা খুশি হলেন, তার ছাপান্ন বছরের জীবনে কোনো পত্রিকার কোনো খবর এতোটা খুশি তাকে করতে পারেনি।
ছবিসহ পত্রিকায় পরিবেশিত খবরটি ছিল এরকম- ‘দুই প্রতারক আটক! আলাল ও জালাল নামের দুই প্রতারক ভুয়া দুর্নীতি দমন অফিসার সেজে দীর্ঘদিন ধরে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছিল। আজ সকালে একই উদ্দেশ্যে জনৈক ব্যবসায়ীকে তারা ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা চালায়। তাদের কথাবার্তায় সন্দেহের উদ্রেক হওয়ায় ব্যবসায়ী গোপনে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদকালে জানতে পারে- তারা আসল নয়; ভুয়া!
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/এএসএম