লালদীঘির নৃশংস হত্যাকাণ্ড
‘গোমেজ কোনোদিন জানবে না সে বাবা হয়েছিল’
২৪ জানুয়ারি। ইতিহাসে কলঙ্কিত একটি দিন। কারণ আজকের দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশে ভিন্নরূপে পরিগণিত। দিনটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য ঘৃণিত ও ন্যক্কারজনক। ইতিহাস নিন্দিত দিনটি ক্ষত এঁকে আছে বাঙালির মানসপটে।
দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধূলিসাৎ করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন নিহত হওয়ার মাধ্যমে।
ঘটনাটি ১৯৮৮ সালের ২৪ জনুয়ারি। চট্টগ্রামের লালদীঘিতে জনসভায় যোগদানের পূর্বে শেখ হাসিনার গড়িবহরে পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। এতে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত এবং দুই শতাধিক নেতাকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন। আহত-নিহতদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী ও সাধারণ জনতা।
নিহত যাদের মরদেহ পাওয়া গেছে তারা হল- মহিউদ্দিন শামীম, রমেশ বৈদ্য,বদরুল আলম, হাসান মুরাদ, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথেলবার্ট গোমেজ ( কিশোর), স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, মো.শাহাদাত, কামাল হোসেন, বি কে দাশ ,পঙ্কজ বৈদ্য , বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া,মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো.কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস ও গোবিন্দ দাশ।
তৎকালীন জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদের’ ধারাবাহিক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ৮ দলীয় জোট নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির।
ঐদিন সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা থেকে বিমানে করে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামেন শেখ হাসিনা। এরপর দুপুর একটার দিকে পূর্ব নির্ধারিত সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে বহনকারী ট্রাকটি মিছিল নিয়ে লালদীঘি ময়দানের দিকে এগোচ্ছিল।
শেখ হাসিনার গাড়ীবহর ও মিছিল নগরীর কোতোয়ালী থানার কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনের সড়ক অতিক্রম করলে পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে। এসময় আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে থাকা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা মানব ঢাল তৈরি করে আইনজীবী ভবনে নিয়ে যান।
মানব ঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন নয় (০৯) জন। নিহতের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জন। এই হত্যাকাণ্ডটি চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিতি পায়। তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা করা হয়। তারই নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের অনেক মরদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর না করে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রধান ফটকের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে নিহত ২৪ জনের নাম লিপিবদ্ধ আছে।
সেসময়ে দৈনিক সংবাদে কর্মরত একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের মধ্যে ‘গোমেজ কোনদিন জানবে না, সে বাবা হয়েছিল’ এবং ‘হাসনা বানু এখনো সংজ্ঞাহীন’ প্রতিবেদন দুটি হৃদয় ছুঁয়েছে। প্রথম প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বরিশালের ছেলে এথেলবাট গোমেজ (কিশোর) চট্টগ্রামে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতো। ঘটনার দিন নগরীর জিপিওতে অফিসের টেলিগ্রাম জমা দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এর দুইদিন পূর্বে এক কন্যা সন্তানের জনক হন গোমেজ। কিন্তু তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজলভ্য না হওয়ায় তিনি জানতে পারেনি। ২৪ জানুয়ারি গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের দিন ২৩ জানুয়ারি গোমেজের মা বরিশালের বাকেরগঞ্জের পাদ্রী শিবপুর গ্রাম থেকে কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণ নিয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু মায়ের পাঠানো চিঠি চট্টগ্রামের জলিলগঞ্জের ট্যাকপাড়ায় গোমেজের বাসায় পৌঁছায় ২৮ জানুয়ারি।
অপর প্রতিবেদন ‘হাসনা বানু এখনো সংজ্ঞাহীন’। ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত মোহাম্মদ হাসানের মা হাসনা বানু। পুত্রের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে অবচেতন হয়ে পড়েন। মোহাম্মদ হাসান রাতে নগরীর নালারবাজার পৌর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। আর দিনের বেলা মাদার বাড়িতে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতো। ঘটনার দিনে মোহাম্মদ হাসান দুপুরে বাসায় খেয়ে কোট বিল্ডিং এর দিকে যায়। এরপর বিকাল তিনটার সময় গুলিবিদ্ধ হলে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে রাত একটায় তার মৃত্যু হয়। হাসানের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে তার মা জ্ঞান হারায়।
এরপর আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদের সামরিক শাসনের পতন হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য ১৯৯২ সালের পাঁচ মার্চ অ্যাডভোকেট মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় মামলার কার্যক্রম এগোয়নি। এমনকি ঘৃণিত এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা মির্জা রকিবুল হুদাকে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের নির্দেশে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করে সিআইডি। দ্বিতীয় দফায় মামলাটি অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর আট পুলিশ সদস্যকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। আসামিরা হলেন-তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কোতয়ালি অঞ্চলের পেট্টোল ইন্সপেক্টর জে সি মণ্ডল, কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মুশফিকুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মো. আব্দুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরে আবারও মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এ মামলায় ১৬৮ জন সাক্ষী ছিল, যাদের আদালতে উপস্থিত করা ছিল কঠিন। মামলার বিচার চলাকালে বাদী অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদা, প্রধান আসামি মির্জা রকিবুল হুদাসহ আরও তিন আসামি মৃত্যুবরণ করেন। আরও মারা যান মামলার চার্জশিট প্রদানকারী সিআইডি কর্মকর্তা এম এ কাদের খান।
অবশেষে ২০২০ সালে ১৪ জানুয়ারি ৫৩তম সাক্ষীর সাক্ষ্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওইদিন আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ১৯ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়। ১৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন শেষে পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। পরে আদালত আসামি পক্ষে যু্ক্তি উপস্থাপনের জন্য ২০ জানুয়ারি দিন ধার্য করে। কিন্তু আসামি পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন না করায় এদিন চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ ইসমাইল হোসেনের চার আসামির উপস্থিতিতে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন আদালত।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতয়ালি থানার তৎকালীন কোতয়ালি অঞ্চলের পেট্টোল ইন্সপেক্টর জে সি মণ্ডল, সাবেক কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, মো. আব্দুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। তাদের মধ্যে জে সি মণ্ডল পলাতক রয়েছেন।
সভ্য সমাজে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা বিরল। শেখ হাসিনাকে হত্যার কম চেষ্টা চালানো হয়নি। এখনও সক্রিয় স্বাধীনতা বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। জাতির পিতার কন্যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হামলায় নিহত নিরপরাধ মানুষের আত্মা শান্তি পাবে রায় কার্যকর হলে। বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর হোক আজকের দিনে সেই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/জেআইএম