বিএনপি থেকে কি জামায়াত দূরে সরছে?
বিএনপির সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়া দীর্ঘদিনের। বলা যায়, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবন ও উত্থান হয়েছে জিয়াউর রহমানের সহায়তায়। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করার পরও স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারতো না।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও জামায়াত কখনো বিএনপিকে ছাড়েনি। বরং খালেদা জিয়া জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী বানিয়েছেন। সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। তবে এই দূরত্ব যে কৌশলগত, কোনোভাবেই আদর্শিক নয়- সেটা বুঝতে বুঝতে কারও কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয় না। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীতে ১০ দফার পক্ষে গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও, জামায়াতে ইসলামী তা করেনি। যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার জামায়াতের ছিল।
জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও আছে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১২ জানুয়ারি স্পষ্ট করে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের সমঝোতা হয়নি। অবশ্য জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টিও আদালতে বিচারাধীন উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভিন্ন কোনো উদ্যোগ নেওয়া ঠিক নয়। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি'।
তবে ওবায়দুল কাদের এটাও বলেছেন যে ‘জামায়াত ছাড়া বিএনপির টিকে থাকা দুষ্কর। নেতিবাচক রাজনীতি করতে করতে বিএনপি যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে, তাদের বড় সমাবেশ, বড় মিছিল করতে হলে জামায়াতকে দরকার। সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষক বিএনপি। জঙ্গিবাদী শক্তির বিশ্বস্ত ঠিকানা বিএনপি। বিএনপি-জামায়াত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাদের একটিকে ছাড়া আর একটি চলবে না।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো না হলেও কৌশলগত কারণে যে জামায়াত কখনো কখনো বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে না, তা-ও তো নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকেছিল জামায়াত।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হলেও তা সরকার করেনি। নিবন্ধন না থাকায় জামায়াত আর নামে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তবে বেনামে বা স্বতন্ত্র পরিচয়ে যেকোনো নির্বাচনে জামায়াতের লোকেরা অংশ নিতে পারে।
কৌশলগত কারণই এখন প্রকাশ্য রাজনীতিতে জামায়াত সেভাবে সক্রিয় না থাকলেও রাজনীতিতে জামায়াত ভালোভাবেই আছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থীরা দলের নাম নিয়ে নির্বাচন করেছে এবং বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির চেয়ে জামায়াতের বেশি প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন বলে পত্রিকায় তথ্য বেরিয়েছে।
এর বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতাও জামায়াত অব্যাহত রেখেছে। মাঝে মাঝেই সেরকম গোপন সভা থেকে জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের খবরও গণমাধ্যমে আসে। সম্প্রতি জামায়াতের আমিরও জঙ্গিদের অর্থ সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাহলে জামায়াতের রাজনীতি শেষ হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই।
গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষনেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন তারাও অবাধে কার্যক্রম চালাতে পারছেন না, দৌড়ের ওপর এবং কেউ কেউ প্রেপ্তার আতঙ্কেও আছেন।
এত কিছুর পরও জামায়াত আছে। জামায়াত আছে, কারণ তাদের পেছনে বিএনপি আছে। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে সেহেতু তারা পরস্পর ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ – কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি, পারছে না।
গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়েও ৩০ ডিসেম্বরের গণমিছিলের মতো কর্মসূচি জামায়াত পালন করেছিল। পুলিশের অনুমতি না পেলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সেদিন জামায়াত মাঠে নামলে মৌচাকে পুলিশের বাধায় পড়ে। সেখানে দলটির অর্ধশত নেতাকর্মী আহত ও গ্রেপ্তার হন।
এলডিপিসহ কয়েকটি দল জামায়াতের মিছিলের বাধার নিন্দা করলেও, বিএনপি নীরব ছিল। এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পরও তাঁর মুক্তি দাবি করে বক্তব্য দেয়নি বিএনপি। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিসহ ১০ দফা ঘোষণা করার আধা ঘণ্টা পর জামায়াত আমির ১০ দফা ঘোষণা করে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দেন। ২৪ এবং ৩০ ডিসেম্বরের গণমিছিল থেকে সারাদেশে জামায়াতের তিন শতাধিক কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের জন্য একটি বিবৃতিও দেয়নি।
৮ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর জামায়াত মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেয়। জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপির এই নীরবতা কৌশলগত কি না, সে প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে আছে। কারণ সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে ছোট ছোট কয়েকটি দল, বিশেষ করে বাম ঘরানার কিছু দলের আপত্তির কারণে বিএনপি দেখাতে চায় যে জামায়াতের সঙ্গে তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। সেজন্য ২০-দলীয় জোট আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির পর রাজধানী ঢাকায় মিছিল-সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি জামায়াত। এর পর থেকে ঝটিকা মিছিলে সীমাবদ্ধ দলটির তৎপরতা। দীর্ঘ ১০ বছর পর গত ২৪ এবং ২৮ ডিসেম্বর ডিএমপিতে আবেদন করে গণমিছিলের অনুমতি চেয়ে। ৩০ ডিসেম্বরের মৌচাকের সংঘর্ষের পর ডিএমপি কমিশনার কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিলেও জামায়াত এর জবাবে বিবৃতিতে জানায়, পুলিশের ওপর তাদের আস্থা রয়েছে, শত্রুতা নেই।
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনায় যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল জামায়াত। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর গঠিত যুগপৎ আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটিতে সব সমমনা দলের প্রতিনিধি থাকলেও জামায়াতের কাউকে রাখা হয়নি। এ নিয়েও ক্ষুব্ধ জামায়াত। জামায়াতের এই ক্ষুব্ধতা কতটা স্থায়ী হবে, দেখার বিষয় সেটাই।
বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব তৈরির খবর প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এটা জামায়াতের নীতিগত অবস্থান নয়, কৌশলগত। সমালোচকদের চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল নিয়েছে জামায়াত এবং বিএনপি। দুই দলই কিছুদিন সম্পর্কের সুতা আলগা করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। তাদের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সরকারকে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে চায় এই দুই দল। আবার এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সরকারও চায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ। সরকারের কাছে বিএনপি এবং জামায়াত – দুই দলই শত্রু । দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়।। তবে জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই সরকার আশু বড় বিপদ বলে মনে করে বলে মনে হয়।
এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতটা বিএনপি, ততটা জামায়াত নয়। তাই বিএনপিকে সরকার এখনই যতটা চাপে রাখতে চায়, জামায়াতকে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু গত নির্বাচনের ফলাফল সরকারকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ করে দিয়েছে। ভোটে জামায়াত জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একটি আসনেও তারা জয় পায়নি।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিটি সরকার সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের বিষয়টি বিবেচনা করেই আমলে নেয়নি বা গা করছে না। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে জামায়াতের বিএনপিতে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এতে হঠাৎ বিএনপির শক্তি বৃদ্ধি ঘটবে, যেমন স্বাধীনতার পর পর জাসদ গঠন হলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির নেপথ্য সমর্থনে ফুলেফেঁপে উঠেছিল।
জামায়াতকে তাপে-চাপে রেখে সরকারও কৌশলের খেলা খেলছে। এই খেলায় সরকার এখন পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেও জামায়াত খুব পিছিয়ে আছে, তেমনটা মনে করা ঠিক হবে না। জামায়াত নিজেদের মতো করে সক্রিয় আছে, তৃণমূলে মানুষের সঙ্গে নানা উছিলায় তাদের যোগাযোগ বহাল আছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি মামলা আদালতে আছে। মামলাটি সচল হবে, না ফ্রিজে থাকবে– সেটা নির্ভর করবে জামায়াতের ভূমিকার ওপর।
এটা জামায়াতও বুঝতে পারছে। জামায়াত বুঝতে পারছে যে, তারা গরম হলে রেহাই পাবে না। সরকারও তখন গরম আচরণ করবে। তাই অকারণে শক্তিনাশের পথে না হেঁটে তারা কৌশলে শক্তি বাড়িয়ে যাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা নিষিদ্ধ হলে কোন কৌশলে আগাবে সেটাই এখন তাদের ভাবনার বিষয়।
সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা দূরত্ব তৈরির গল্প বাজারে ছাড়ছে না তো? জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে, তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফনা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে একই কৌশল বারবার ভালো ফল দেয় না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস