ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আমাদের অঙ্গীকার

মোনায়েম সরকার | প্রকাশিত: ০৯:১৩ এএম, ১০ জানুয়ারি ২০২৩

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ নয় মাস তিনি অন্ধকার জেলখানায় আটক থাকেন। সেখানে তাঁকে হত্যার চক্রান্তও করা হয়। কিন্তু সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে যুদ্ধজয়ী বীরের বেশে স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জানুয়ারির ৮ তারিখ (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের ৬৩৫ নং ফ্লাইটটি লন্ডনে পৌঁছালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিসের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা বিমানবন্দরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিমানবন্দর।

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’-এ ওঠেন। এখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর প্রতি সাংবাদিকদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, তিনি কেন ঢাকায় না গিয়ে প্রথমে ব্রিটেনে এসেছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকারের। আমি তাদের কাছে বন্দি ছিলাম।’

লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা পোষণ করেন। এ কথা প্রচারের কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটেনের সরকারি কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওইদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ তখন সদ্যস্বাধীন। পরাক্রমশালী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা মি. হিথ নিজে খুলে দেন।

‘হিথ-মুজিব’ সাক্ষাৎকালে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এডওয়ার্ড হিথ যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ে স্বীকৃতি প্রদানের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পর কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হোটেল কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ৯ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু দিল্লির উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন।

১০ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রয়াল এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমানটি দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উজ্জ্বল সূর্যালোকে দৃপ্ত পায়ে বিমান থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার নয়নের মণি। তার পরনে ছিল ধূসর রঙের স্যুট ও কালো ওভারকোট। তিনি নামার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানে প্রবেশ করেন। তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরেন প্রিয় নেতাকে। ২১ বার তোপধ্বনি করে ভারত অভিবাদন জানায় বাংলাদেশের মহান নেতাকে।

ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একত্রে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশের কূটনীতিকরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন। পুরো এলাকা বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকায় সজ্জিত ছিল। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। দিল্লিতে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন বঙ্গবন্ধু। সেখানে বাংলায় ভাষণ দিয়ে দিল্লির মানুষের মন জয় করেন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল। অবতরণের আগে ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের কমেট বিমানের পাইলটরা বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বিমানটি নিয়ে ঢাকার আকাশে চক্কর দেন। বঙ্গবন্ধু অশ্রুভরা চোখে দেখেন তার যুদ্ধবিধ্বস্ত বিরাণ বঙ্গভূমি। অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। মহান নেতা এসে দাঁড়ালেন তার প্রিয় জনগণের মধ্যে। বাংলার মানুষ আনন্দাশ্রু আর ফুলেল ভালোবাসায় বরণ করে নিলো তাদের প্রাণের নেতাকে। ৩১ বার তোপধ্বনি হয় তেজগাঁও বিমানবন্দরে।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। তাঁকে বহনকারী গাড়িটি জনতার ভিড় ঠেলে অত্যন্ত ধীরগতিতে এগোতে থাকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের দিকে। তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বহনকারী ট্রাকটি লাখ লাখ জনতার মধ্য দিয়ে চলে প্রায় দুই ঘণ্টায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছায়।

ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতা আর দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি আবার আপনাদের কাছে এসেছি। লাখ লাখ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে...।’

তখন এমন কোনো মানুষ ছিল না, যার নিজের চোখে পানি জমেনি এবং আবেগে গলা রুদ্ধ হয়ে ওঠেনি। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছিল। তিনি যখন মুক্ত হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলার মাটিতে আসেন, সেদিনই সূচিত হয় বাংলাদেশের প্রকৃত বিজয়। পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা।

১০ জানুয়ারি এলেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা তাই বাঙালির মনে দোলা দেয়। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একই সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির অঙ্গীকার। আবার এটাও ঠিক, বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলা ও বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে জাতির পিতা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের যে গৌরব ছিল, তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় স্বাধীনতার পর। ছাত্রলীগ থেকে যেমন অনেক ত্যাগী মানুষের জন্ম হয়েছে, তেমনি অনেক বিশ্বাসঘাতকও জন্ম নেয় এ প্রতিষ্ঠান থেকে। ছাত্রলীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে ছাত্রলীগের অনেকেই খুনি মোশতাকের সঙ্গে যোগ দেন। কেউ কেউ গড়ে তোলেন আলাদা আলাদা দল। ছাত্রলীগের হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই এখন আওয়ামী লীগবিরোধী জোটে বসে ষড়যন্ত্র করছেন।

বঙ্গবন্ধুর অনেক ঘনিষ্ঠ কর্মীও বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ঘাতক গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে সেদিনের অনেক ছাত্রনেতাও একাত্ম হয়েছিলেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে সক্রিয় ছিল দেশি-বিদেশি ঘৃণ্য চক্রান্ত। সেই চক্রান্ত বাস্তবায়ন করতে বিদেশিরা এদেশের কতিপয় লোভী ও বিভ্রান্ত রাজনৈতিক কর্মীকে ব্যবহার করে।

জাসদ সৃষ্টির পরই বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। জাসদের উগ্রবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। জাসদ যদি বিপদগামী না হয়ে দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর কাজে হাত লাগাতো, তাহলে অন্যরকম হতো বাংলার ইতিহাস। আজ একটি প্রশ্ন বারবার আমার মাথায় ঘুরপাক খায়, যে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়, যার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য লাখ লাখ মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে- সেই মহান নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষ কেন ঘর থেকে বের হলো না?

এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছেই নেই। বঙ্গবন্ধু আসলে কোনোদিনই ভুল ছিলেন না, ভুল বুঝেছিলাম আমরা। কিছু বিশ্বাসঘাতক নেতাকর্মী লাভের কারণে ও লোভের বশবর্তী হয়ে তাঁকে আকাশ থেকে টেনে মাটিতে নামিয়েছিল। আর ছাত্রলীগের বিভ্রান্ত নেতারা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে উগ্র মতবাদ প্রচার করে রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ প্রশস্ত করে। আজ তারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। শুধু বাংলাদেশে নয়, এখন সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধুই সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত। বিভ্রান্ত নেতারা সঙ্গত কারণেই আজ পরিত্যক্ত।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আঁধার হানা দিয়েছিল বাংলার জনপদে। তারপর ২১টি বছর শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে চেষ্টা করে তাঁকে মুছে ফেলার। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর আবারো মাথা উঁচু করে বাংলাদেশ অভিষিক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। আর সূর্যের মতো উদিত হয়েছেন জাতির জনক তাঁর মহিমায়। এ সূর্য, এ আলোকিত দিন কখনো হারাবার নয়।

ঝোপঝাড়ে ঘাপটি মেরে থাকা দানবীয় শক্তির উত্থান যাতে আর কখনো ঘটতে না পারে, সে দায়িত্ব এখন বুঝে নিতে হবে। জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৫১তম বার্ষিকীতে এ দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিগত বছরগুলোতে তার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন। আমাদের এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা।

আশা করি, নতুন প্রজন্ম সব বিভ্রান্তি ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধু। উল্লেখ্য, শুধু বাংলাদেশে নয়- জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তর ও বিশ্বের বহু দেশ তার জন্মশতবর্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করেছে। এটা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক সংবাদ। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে মানবিক বিশ্ব গড়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম