কেমন যন্ত্র বাহে মুই ভোট দিবার পাং নাই
আক্ষেপ একজন ষাটোর্ধ্ব ভোটারের মধ্যে। তিনি খুব সকালে রংপুর সিটি করপোরেশনের একটি কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। ইভিএম মেশিনে তার আঙুলের ছাপ মেলেনি। তাই তাকে ভোট না দিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। এর আগে তিনি বহুবার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবারের মতো বিড়ম্বনার শিকার কখনও হতে হয়নি।
তার কথা হলো, আমি তো চোর ডাকাত কেউ না, সবাই আমাকে চিনলেও মেশিন আমাকে চিনতে পারলো না। জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ভোটার আইডি মিললেও ভোট দিতে না পেরে তিনি কান্না করেছেন। সবাইকে বলছেন, ‘এটা কেমন যন্ত্র বাহে, মুই আগে কত ভোট দিছলুং কিন্তু এবার ভোট দিবার পাং নাই।’ সবার কাছে একথা বলতে গিয়ে নিকট ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন।
বহু কাঙ্ক্ষিত রংপুর সিটি করপোশেনের নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে বলে খবর প্রচারিত হয়েছে। ভোটের দিন দিবাগত রাত ১২টার পর রংপুর শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ অফিস থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। জাতীয় পার্টির ঘাঁটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা মোট এক লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
রংপুর সিটিতে ৩৩টি ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র ২২৯টি। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯। ভোট প্রদান করেছেন ২ লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন। ভোট প্রদানের হার ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এবারের ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে ইভিএম মেশিনে। তবে অনেকগুলো কেন্দ্রে ইভিএম নষ্ট হয়ে গেলে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়। এত ভোট প্রদান বন্ধ হয়ে গেলে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক ও অসুস্থ ভোটারদের মধ্যে বিড়ম্বনা থেকে বিষাদময় পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়। কোনো কোনো কেন্দ্রে এই পরিসংখ্যান ১০ থেকে ২০ শতাংশ (যুগান্তর ২৮.১২.২০২২)।
শিক্ষাঙ্গন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৩নং বুথে এই চিত্র ছিল উদ্বেগজনক। এখানে ইভিএমের সেন্সর কাজ করেনি। ভোটার লিস্টে অনেকের নাম অনুযায়ী ভোটার আইডি মেলেনি। অনেকের আঙুলের ছাপ মেলেনি। এজন্য ১০ শতাংশ মধ্যবয়স্ক ও ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ২০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পারেননি। সালেমা উচ্চ বিদ্যালয়ে শ্রমজীবীদের আঙুলের ছাপ মেলেনি। আঙুলের ছাপ না মেলায় আইজিএস স্কুলে কেন্দ্রে ৯ জন ভোট দিতে পারেননি। মাহিগঞ্জ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পারেননি। একজন প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, তাই বিকেল ৪টার নির্ধারিত সময়ে ৪০ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শেষ করা সম্ভব হয়নি। ভোট বন্ধ রেখে ইভিএম মেরামত করতে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন সেখানকার কর্মরতরা।
এত কিছুর পরও ভোটপ্রদানে বঞ্চিতদের বাদ রেখে সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন হয়েছে। ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও কোনোরূপ প্রতিবাদ ছাড়া সবাই ফলাফল মেনে নিয়েছেন। তবে অনেক ঝামেলা হয়েছে কমিশনার প্রার্থীদের নিয়ে।
ভোরে দিন দিবাগত রাত ৯টার দিকে একজন কমিশনার প্রার্থীর ফলাফল জানার সাথে সাথে তার সমর্থকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেছেন। নগরীর আমাশু ককুরুল এলাকার কমিশনার প্রার্থী হারাধন রায় হেরে গেলে তার সমর্থকরা দায়িত্বরত একটি বিজিবির গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া কমিশনার প্রার্থীরা ভোটের পরদিন ২৯ ডিসেম্বর বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সংবাদ সম্মেলন করে নানা অনিয়ম ও ইভিএম পদ্ধতির জটিলতা এবং বিড়ম্বনার প্রতিবাদ করেছেন। তারা তাদের ওয়ার্ডের ফলাফল বাতিলের আবেদন জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, ইভিএম একটি ধীরগতির যন্ত্র। এটা দিয়ে স্বাভাবিক ভোট হয়নি। তার ওপরে বহু মেশিন নষ্ট হওয়ায় কোথাও কোথাও সাড়ে তিন ঘণ্টা ভোট বন্ধ ছিল। তাই অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেনি। এ মেশিন দিয়ে এত দ্রুত অনেকগুলো মানুষের ভোট নেওয়া সম্ভব নয়। মেশিন মেরামত করে অনেক কেন্দ্রে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হলেও অনেক নারী ও বয়স্ক ভোটার ততক্ষণে বাড়ি চলে গেছেন। বিজয়ী মেয়র বলেছেন, ‘মেশিনের অভাবে ভোট কম পোলিং হয়েছে। সবাই ঠিকমতো ভোট দিতে পারলে আমি দুই লাখেরও বেশি ভোট পেতাম।’
রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোট কোনরকমে শেষ হলেও এবারের ভোটের ফলাফল কীসের ইঙ্গিত দিয়েছে? সেটা একটি জটিল প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির নির্বাচিত প্রার্থীর সাথে বর্তমান সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর ভোটের ফলাফলের সংখ্যায় ব্যাপক ব্যবধানের চিত্র অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে। তারা তাদের এই ভোট বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন।
শুধু রংপুরবাসী নয়, গোটা দেশবাসী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর হেরে যাওয়াকে অনেকটা বিস্ময়ের সাথে পর্যালোচনা করছেন। তার এই হেরে যাওয়াটা যদি সামান্য ব্যবধানে হতো তাহলে কেউ ততটা অবাক হতো না। বিশেষ করে দেশের প্রদান বিরোধী শক্তি বিএনপি এই ভোটে অংশগ্রহণ করেনি। অনেকে বলেছেন, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও আরও একজন বিদ্রোহী আওয়ামী প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেছে, বিদ্রোহীসহ দুজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান যথাক্রমে তৃতীয় ও হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া চতুর্থ স্থানে রয়েছেন।
তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা (৩৩,৮৮৩+২২,৩০৯=৫৬,১৯২) হিসাব করলেও বিজয়ী মেয়র মোস্তফার মোট ভোটের চেয়ে ৯০,৬০৬ ভোট কম। দ্বিতীয় হয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের আমিরুজ্জামান পিয়াল তার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ৪৯,৮৯২টি। আর মেয়র মোস্তফা পেয়েছেন ১,৪৬,৭৯৮ ভোট। এতে দেখা যাচ্ছে, রংপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরিস্থিতি খুব নাজুক। সেখানে জাতীয় পার্টির দুর্গ এখনও জয়জয়কার ধ্বনি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা এই ফলাফলে বেশ চিন্তিত ও বিস্মিত হয়ে পড়েছেন।
ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা নিয়ে অনেকদিন ধরে নানা বিতর্ক চলে আসছে। তবুও অসাড় যুক্তিতর্ক দিয়ে এটাকে চালানোর প্রচেষ্টার কমতি নেই। রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সৃষ্ট সমস্যাগুলো ইভিএমের দুর্বলতাগুলোকে হাতে কলমে দেখিয়ে দিয়েছে। আশা করি এবার কর্তৃপক্ষের জোরেশোরে টনক নড়বে।
প্রযুক্তি বিকল হওয়ার কথা বাদ দিলাম। কারণ, মিলিয়ন টাকায় কেনা মেশিনও যে কোনো সময় অজানা কারণে বিগড়ে যেতে পারে। সেজন্য যে কোনো মেশিন ব্যবহারের সময় দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় প্রস্তুত রাখতে হবে। আমার এক শিক্ষক প্রায়ই বলতেন, ‘যখন তোমার দুটি গাড়ি কেনার ক্ষমতা হবে শুধু তখনই তোমার প্রথম গাড়িটা কিনো। কারণ, প্রথম গাড়িটা কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে পরদিনই যেন তুমি আরেকটি নতুন গাড়ি কিনে রাস্তায় নামতে পারো। তা না হলে লোকের নানা কথায় তোমার মানসিক অসুখ হবে।’ বিষয়টা আসলেই বড় করে ভাবা দরকার। তারও আগে খারাপ রাস্তা, নকল জ্বালানি তেল, সিগন্যালহীনতা ইত্যাদির সাথে ভাবতে হবে- আমি নিয়মানুযায়ী গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত হলেও অন্য অনেক অদক্ষ চালক যে কোনো সময় আমার গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে দিতে পারে।
এছাড়া যেসব বিষয় আমাদের অভ্যাস, কৃষ্টি ও মর্যাদার সাথে জড়িত সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য মটিভেশন কর্মসূচির প্রচেষ্টাও থাকতে হবে। যেমন একটি কেন্দ্রে যখন একজন সত্তরোর্ধ্ব ভোটারকে বলা হলো- ‘হাতখানা ধুইয়া আইসো, তোমার হাতোত ময়লা বাহে’। এতে তিনি নিজেকে অপমানিত ভেবে, লজ্জা পেয়ে আর হাত ধুয়ে ফিরে আসেননি।
এভাবে একজন প্রিসাইডিং অফিসারকে বলতে শোনা গেছে, বাইরে গিয়ে সাবান দিয়ে বা লেবু ঘষে হাত ধুয়ে আসুন। বৃদ্ধ ভোটার দুই ঘণ্টা লাইন ধরে অপেক্ষার পর তারে পাশের আরেকজন বলেছেন, ‘হাতখানা ধুইয়া আইসো। এক ভোট দিতে দুই ঘণ্টা নাগলে আর ভোট দিবার নাগবে না’ (প্রথম আলো ২৮.১২.২০২২)। অর্থাৎ তিনি ক্ষোভের সুরেই বলেছেন- একটি ভোট দিতে দুই ঘণ্টা দেরি হলে আর কাউকে এমন ভোট দিতে আসতে হবে না।
আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা হলো- ‘ইনডিজিনাস ওয়ে’ বা দেশজ পরিস্থিতি নিয়ে না ভেবে আধুনিক হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালানো। নিজের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য গভীর মৌলিক কোনো গবেষণা ছাড়াই কাজে হাত দিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাবুডুবু খেয়ে অপচয় ঘটানো আমাদের পুরোনো স্বভাব। নিজেদের চেষ্টায় মেধা খাটিয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়ে দেশজ কৃষ্টিসঞ্জাত বা অভ্যাস সমর্থিত লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মধ্যে আমাদের দেশের আসল উন্নয়ন নিহিত।
আমাদের দেশে ভোটাররা এখনও ততটা সচেতন ও দক্ষ হয়ে ওঠেনি যে তারা ইভিএম দিয়ে ভালোভাবে ভোট প্রদান করতে সক্ষম। তারা অনেকেই এখনও ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে গিয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) দেখে বুঝতে পারছেন না সেটার কোথায় টিপতে হবে। রংপুরের পর গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এটাই বড় বাস্তবতা।
একটি সিটি করপোরেশনের শিক্ষিত ভোটাররা যদি সেটা বুঝতে অপারগ হয় তাহলে জাতীয় নির্বাচনের সময় সারাদেশের গ্রামগঞ্জের ভোটারদের বেলায় আরও কিরূপ ভয়ংকর পরিস্থিতি ঘটতে পারে তা বলাই বাহুল্যে। এসব আধুনিক ধারণাকে সবার ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হলে আমাদের আরও ঘনশ্রম দিয়ে বহুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। [email protected]
এইচআর/ফারুক/জেআইএম