পথে মৃত্যু
সড়ক দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুহার, দুই-ই ক্রমবর্ধমান। আমাদের সড়ক মহাসড়ক সবই যেন মরণফাঁদ। পথ মানুষকে পৌঁছে দেয় জীবনে। কিন্তু আমাদের সড়ক পথ নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। চার বছরের মধ্যে গত বছরটি ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০২২-এ সড়ক দুর্ঘটনার যে চিত্র তুলে ধরেছে তা ভয়াবহ। ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৫৪৮ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনা আর পরিবহন নৈরাজ্য একসাথে চলছে বাংলাদেশে। এক মূর্তিমান বিপদ সড়ক দুর্ঘটনা, বলেকয়ে যা আসে না। কত পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয় একটা দুর্ঘটনা তার হিসাব নেই। দিন দিন পথ দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, কিন্তু কোনো জায়গা থেকেই এর রাশ টেনে ধরার উদ্যোগ নেই। একটা বড় কারণ, এসব দুর্ঘটনায় অতি সাধারণ পথচারী ও যাত্রী এবং দরিদ্র পরিবহন শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটে বিধায় তা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই কোথাও।
যারা মারা যাচ্ছে এদের বড় একটা অংশ কিশোর ও তরুণ। কারণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি বেড়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কে বাস-ট্রাকের মতো ভারী ও দ্রুতগতির যানের সঙ্গে মোটরসাইকেল-ইজিবাইকের মতো হালকা ও ধীরগতির যানও গণপরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। বলা হয় ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যবহার করে মালিক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুরো সিস্টেমকেই নিজেদের করায়ত্ব করেছে। এ কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের যেসব একেবারে মৌলিক পদ্ধতি, সেগুলোই প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
চার বছর আগে পাস হওয়া নিরাপদ সড়ক আইন যেটি আজও কার্যকর করা যায়নি। পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক নেতাদের এক ভয়ংকর ঐক্য জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইনকে আটকে রেখেছে শুধু নিজেদের স্বার্থ ঠিক রাখার জন্য। সড়ক নৈরাজ্যের সেরা দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চলেছেন বাংলাদেশের গণপরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট নেতারা।
সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করতে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনাও জারিও হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো পালিত হয়নি। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে।
জাতীয় সড়কের চরিত্র অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ, সেখানে চলাচল করা যানবাহনের বিন্যাস, তাদের গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি ও প্রয়োজন মতো দণ্ডবিধান- এ কাজগুলো কখনও যথাযথ ভাবে হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর নেই। এসব কারণেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা থামছে না।
কোন আইন বা নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলেই পরিবহন ধর্মঘট করে যাত্রীদের জিম্মি করার কৌশল নেয় পরিবহন মাফিয়া গোষ্ঠী। বাংলাদেশে আর কোনো খাত নেই যেখানে নৈরাজ্যের পক্ষে মালিক শ্রমিকের এমন একটা ভয়ংকর ঐক্য দেখতে পাওয়া যায়। সড়ক আইন রুখতে আমরা দেখেছি পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙছে, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ও চালক উভয়ের মুখে পোড়া মোবিল লাগিয়ে দিচ্ছে। মোটরসাইকেল, সিএনজি, রিকশা এমনকি ভ্যানও চলাচল করতে তারা বাধা দিয়েছে। এগুলো তারা করেছে পুলিশের নাগের ডগায়, বিনা বাধায়। এতেই বোঝা যায় রাজনৈতিকভাবে কতটা প্রশ্রয় উপভোগ করে পরিবহন খাতের শেঠরা।
২০১৮ সালে সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনটিতে জরিমানার পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো ছাড়া এমন কোনো বিধান রাখা হয়নি, যাকে সম্পূর্ণ নতুন বলা যাবে। শাস্তি ও বিচারের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট নমনীয়তা দেখানো হয়েছে নতুন আইনে। তবু এই আইনটিকে কার্যকর করতে দেওয়া হয়নি। এবং আমাদের যে একটি সড়ক মন্ত্রণালয় আছে, একটি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আছে তাদের দিক থেকে উদ্যোগও ছিল না আইনটি কার্যকরা করার ব্যাপারে।
দেশে গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। তাই দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বেশি জোর দিতে হবে ব্যবস্থাপনায়। প্রথমেই নজর দিতে হবে সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে। উন্নয়ন ও মেরামতের জন্য আমাদের সড়কগুলো যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচলের জন্য প্রস্তুত থাকে না। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বাস ও ট্রাকচালকদের বেপরোয়া আচরণ বড় ভূমিকা রাখছে। তারা সাধারণত ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করে না, মানুষের জীবনের ব্যাপারেও তাদের ভেতর সংবেদনশীলতা কম।
বলতে গেলে পথচারী ও যাত্রী, উভয়কেই তারা মানুষের পর্যায়ে বিবেচনা করেনা। মহাসড়কে মোটরসাইকেল, নসিমন, করিমন, ইজিবাইকের মতো বাহন এবং সিএনজি বড় গাড়ির জন্য যেমন প্রতিবন্ধক, তেমনি দুর্ঘটনা সহায়ক। মোটরসাইকেলকে কোন বিবেচনায় গণপরিবহন বানিয়ে ফেলা হরো সেটা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন।
অবৈধ ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক এবং ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ির মালিক, চালক ও শ্রমিকরাই পরিবহন খাতকে নৈরাজ্যের মধ্যে রেখেছে। এদের সহায়ক দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে রাজত্ব করা কিছু পরিবহন শ্রমিক নেতা ও মালিক। এরা আইন করতে দেয় না, আইনের বাস্তবায়ন চায় না, এমনকি আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা প্রণয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।
গত বছর এত মানুষের মৃত্যু যদি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এতটুকুও ভাবায়, আমরা ভাবতে পারি যে, তারা কিছু করবেন সড়কে গণহত্যা থামাতে। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিধর নয় পরিবহন দুর্বৃত্তরা।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস/ফারুক