ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জের বছর

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ০৫ জানুয়ারি ২০২৩

চলতি বছরটি নির্বাচন কমিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, মেয়াদ শেষ হওয়া সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, মাসখানেকের মধ্যে ৬টি সংসদীয় আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ অনির্ধারিত উপ-নির্বাচন করতে হবে তাদের। সবই রুটিনকাজ। কিন্তু এর চেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি তাদের মোকাবিলা করতে হবে, তা হচ্ছে নিজেদের আস্থা তৈরি।

সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ এই নির্বাচন কমিশনকেই অযোগ্য মনে করে। তারা দাবি করে, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না। সেই অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের বেশ কিছু নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। অবশ্য অতীত সাক্ষ্য দেয়, এ দেশে সরকারবিরোধী দলের নিয়মিত অবস্থান এটা।

বিরোধী দল সবসময়ই বলে নির্বাচন কমিশন সরকারের তল্পিবাহক। সরকার যেভাবে চায় তারাও তেমনি কাজ করে। এমন অভিযোগ সবসময়ই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিরোধী দল নির্বাচনে জয়ী হলে তারা এমন অভিযোগ থেকে আপনাআপনি সরে আসে। পরাজিত হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরও তাদের এই অভিযোগ বহাল থাকে। নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন আখ্যায়িত করাও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত।

তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনে আস্থা নেই এমন বলার পরও আইনগত বিষয় প্রতিপালন করতে গিয়ে সরকারবিরোধী বিএনপি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে ঠিকই। তাই মনে করা যায়, বর্তমান বিএনপি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যতই হুংকার দিক না কেন সময় হলে তারা ঠিকই নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে।

নির্বাচন কমিশন ইভিএম মাধ্যমে ভোটগ্রহণের বিষয়ে জোরালো অভিমত দিয়েছে। তাদের এই চিন্তার সঙ্গে সরকারি দলের দূরত্ব নেই খুব একটা। বিভিন্ন বক্তব্যে সরকার ইভিএমের পক্ষে মতামত দিয়ে আসছে। কিন্তু বিএনপি ইভিএমবিরোধী। তারা সবসময়ই ইভিএমকে সূক্ষ্ম কারচুপি কিংবা ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যম হিসেবে বলে আসছে।

বড় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির বিরোধিতার পরও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন নির্বাচনে কমবেশি ইভিএম ব্যবহার করে আসছে। ভোটারদেরও ইভিএমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা গেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও নানা মত রয়ে গেছে এখনও। পক্ষে-বিপক্ষে তাদের মত প্রকাশ করতে দেখা যায়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন কমিশন পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তত ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করবে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম সফল করতে হলে বিরোধী দলের সম্মতির বিষয়টি আমলে আনতে হবে। সরকার নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক সাপোর্ট দিচ্ছে এর পাশাপাশি লজিস্টিক সাপোর্টও দিতে হবে। কিন্তু সেই সাপোর্ট কতটা দিতে পারবে সরকার তা ভেবে দেখার বিষয় আছে। জনবল থেকে শুরু করে আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে।

নির্বাচন কমিশন আর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইভিএম প্রশ্নে মতৈক্য হওয়া এবং সরকারের কাছ থেকে এই কার্যক্রম সফল করতে লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়ার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন কমিশন কতটা সফল হবে। যতটা জানা গেছে ইভিএম প্রকল্প এখনও পাস হয়নি।

ফলে নির্বাচন কমিশন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কতটা সক্ষম হবে, সেটি সন্দেহযুক্তই থেকে যাচ্ছে। আগের নির্বাচন কমিশনও ইভিএম ব্যবহারে আগ্রহী ছিল। তারাও ইভিএম ব্যবহারে অনাগ্রহী রাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারের পর ভোটারদের সন্তুষ্টিও তারা দেখেছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, ইভিএম ব্যবহার নির্বিগ্ন হয়নি। সবশেষে ইভিএম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের যে সহযোগিতা প্রয়োজন তা চলতি মাসের মধ্যে যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অধিকহারে ইভিএম ব্যবহার কতটা সম্ভব হবে তা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো রাজনীতির মাঠকে গরম করে দিতে পারে। এই নির্বাচন কমিশনকে পাঁচটি সিটি নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে। প্রথম নির্বাচন হবে গাজীপুরে, যা করতে হবে আগামী ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আর শেষ নির্বাচনটি হবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের।

যা করতে হবে ১৩ নভেম্বরের মধ্যে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে এমন বড় বড় নগরীর নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের উত্তেজনাকালেই অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি নির্বাচনেই থাকবে দলীয় প্রার্থীদের অংশগ্রহণ। বিএনপি এই মুহূর্তে নির্বাচন বয়কট করে এলেও আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কী হতে পারে এখনও স্পষ্ট নয়।

দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয় নেতাদের কিছুটা ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকেই। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন সিটি নির্বাচনগুলোতে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও উন্মুক্ত করে দিতে পারে বিএনপি প্রার্থীদের জন্য। কর্মীদের ওয়ার্মআপ হিসেবে এই নীতি গ্রহণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে নারাজ অনেকে।

সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সরবরাহ, বিধিবিধান অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর নিরীক্ষা, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্বাচনে অধিকতর প্রযুক্তি ব্যবহার এবং পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে উল্লেখিত সময়ে।

এদিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যে মন্তব্য করছে, সেই পথে তাদের স্থির থাকা সম্ভব হবে না। তাদের রাজনৈতিক গতিধারা লক্ষ্য করলে অনুমান হতে পারে, তারা হয়তো নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবি থেকে সরে এসেছে। কিংবা এই দাবিটি একান্তই রাজনৈতিক চাল হিসেবেই তারা হাতে রেখে দিচ্ছে।কারণ এই দাবি আদায় করতে গেলে তাদেরই অধিক ছাড় দিতে হবে।

আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে বর্তমান ইসিকেই প্রচণ্ড চাপে থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেই কর্মপরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই একবছর তাদের দিনভিত্তিক রুটিন বাস্তবায়নে তৎপর হতে হবে। আর বাস্তবতাও তাই বলে। এই অবস্থায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিটি এমনিতেই বাতিল হওয়ার পথে। রাজনৈতিক চাপ হিসেবে বিএনপি তাকে গ্রহণ করা ব্যতিরেকে কিছুই করার নেই তাদের সামনে।

সুতরাং নির্বাচন কমিশন ভাবতেই পারে একটি রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তারা সক্ষম হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান যে কোনো নির্বাচন কমিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে কমিশনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। আবার তাদের সাফল্য ব্যর্থতাও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর মূল্যায়ন হয়। সেই পরীক্ষায়ই অবতীর্ণ হবে এবছর।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, গবেষক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন