বিএনপির কি শক্তি বেড়েছে?
২০২২ সালের শেষ দিকে রাজনীতির মাঠ যে রকম গরম হয়ে উঠেছিল, ২০২৩ সালের শুরুটা তত উত্তপ্ত নেই। তবে তার মানে এই নয় যে রাজনীতিতে এই বছর শীতল হাওয়া বইবে। বরং পরের বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা রকম মেরুকরণ ঘটবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। একদল ক্ষমতায় আছে টানা তিনি মেয়াদে, এখন এই মেয়াদের শেষ বছর চলছে। আরেক পক্ষ ক্ষমতার বাইরে আছে ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে। আওয়ামী লীগের চেষ্টা আরও এক মেয়াদ অন্তত ক্ষমতায় থাকা। বিএনপির চেষ্টা আওয়ামী লীগকে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতাচ্যুত করা। দুই পক্ষ এখন মুখোমুখি লড়াইয়ের ময়দানে।
জেতার সম্ভাবনা কার বেশি? এটা নিয়েই নতুন বছর জুড়ে চলবে রাজনীতি। কেউ বলবেন, আওয়ামী লীগকে হারানো সহজ নয়। কারণ এই দলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানেন, রাজনীতিতে এগিয়ে থাকার জন্য কখন কোন চাল দিতে হবে। গত ৪০ বছরের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে রাজনৈতিক কৌশলে তিনি এগিয়ে। তিনি যা করতে চান, সেটা যত বাধাবিঘ্নই আসুক তিনি করে ছাড়েন। কিন্তু বিএনপি যা বলে তা করতে পারার রেকর্ড কম। বিএনপি কোনো দাবি আদায় করতে পারে না।
আবার যারা শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না, তারা বলবেন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা নেই। টানা ক্ষমতায় থেকে দলটি নানা কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখন ক্ষমতায় আছে গায়ের জোরে বা শক্তির জোরে। মানুষ যদি ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় তাহলে ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে না। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কা প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় থেকে এটা অনেকে মনে করছেন যে, আওয়ামী লীগের ভাগ্যে এই রকম লজ্জাজনক পরিণতিই আগামী নির্বাচনে অপেক্ষা করছে। রংপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া থেকে যারা আওয়ামী লীগ শেষ ভাবছেন, তারা বেশি সরল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন হয়তো। রংপুরের ফলাফল থেকে অবশ্যই আওয়ামী লীগের কিছু শেখার আছে, আওয়ামী লীগ যে ধারায় চলছে, সে ধরায় চললে বিপদও আছে কিন্তু একটি সিটির নির্বাচন, যেটা আবার জাতীয় পার্টির দু্র্গ হিসেবে পরিচিত, সেখানে জামানত খুইয়েছে বলেই সব শেষ হয়েছে বলে মনে করা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগকে অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। প্রথমেই ভাবতে হবে, বাংলাদেশ নির্বাচনে জেতার প্রধান শর্ত বেশি উন্নয়ন করা নয়। বাংলাদেশ ভোটে জেতার জন্য মানুষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক একটি বড় ব্যাপার। আওয়ামী লীগের অনেকেই মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়ার কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের নেতাদের কারো কারো মধ্যে প্রবল। তারা নত হতে জানেন না, তাদের আচরণে ঔদ্ধত্যের প্রকাশ দৃষ্টিকটুভাবেই ধরা পড়ে। আওয়ামী লীগকে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। যাকে তাকে নৌকা দিলেই মানুষ যে ভোট দিতে ছুটে যায় না, রংপুরে তা প্রমাণ হয়েছে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে, কেন দলের অফিসিয়াল প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি ভোট পান?
রংপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ে বিএনপির উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। রংপুরে দ্বিতীয় হয়েছে হাতপাখা প্রতীকের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী আন্দোলন কি বিএনপির মিত্র? যদি ধরেও নেওয়া হয়, আওয়ামী লীগের যারা বিরোধী তারা সবাই এখন বিএনপির মিত্র, তাহলেও প্রশ্ন, বিএনপি এই মিত্রকে কিন্তু নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন নির্বাচন করছে। আগেই বলেছি, বিএনপি যেমন সরকারকে বিব্রত করার জন্য ঐক্যের পরিধি বিস্তৃত করতে চাইছে, তেমনি আওয়ামী লীগ বা সরকারও তো বিএনপির ইচ্ছাপূরণে বাধা সৃষ্টির উপায় খুঁজছে। আওয়ামী লীগ যে বিএনপিকে মিত্রহীন করার কৌশল খুঁজছে না তা তো নয়!
বিভাগীয় সমাবেশ করে বিএনপি যে মুনাফা অর্জন করেছিল, তা কি আবার ক্ষতির ঘরে যায়নি? ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশের স্থান নিয়ে জেদাজিদি করতে গিয়ে বিএনপি কি খুব লাভবান হয়েছে? মনে হয় না। শেষপর্যন্ত দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ আরো কয়েকজন নেতার গ্রেপ্তারের পর বিএনপিকে সরকারের শর্তে রাজি হতে হয়েছে। সরকার চাইলে বিএনপিকে চাপে ফেলতে পারে, বিএনপি ইচ্ছে করলেই সরকারকে খুব বেকায়দায় ফেলতে পারে না। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে গিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করে সরকারের জন্য কি চ্যালেঞ্জ তৈরি করলো, তা একেবারেই পরিষ্কার নয়। বরং বিএনপির একজন প্রবীণ নেতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে গত নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত ও ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগী আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া পদত্যাগের মাস না গড়াতেই বলেছেন, জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সদস্যদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত দূরদর্শী ছিল না। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। সাত্তার ভূঁইয়াকে এখন সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী ইত্যাদি বলে তিরস্কৃত করা হলেও তিনি তো পাঁচবার বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি টানা ২৭ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন।
এখন তিনি দল ছেড়েছেন, দলের সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলেছেন, কাজেই এখন তার বিরুদ্ধে অনেক কথা বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এ-ও এক নিকৃষ্ট দিক। দলে থাকলে ফেরেস্তা, দল ছাড়লে শয়তান। তবে বিএনপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করা না করায় রাজনীতিতে বড় কোনো অঘটন ঘটেছে তা কি মনে হচ্ছে? ৬ আসনের তিনিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে। একটি পেয়েছে জাসদ, একটি ওয়ার্কার্স পার্টি আর একটি আছে উন্মুক্ত। তবে আওয়ামী লীগ তিন আসনে প্রার্থী না দিলেও দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে না, তা তো নয়। এখন বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনের ফলাফল কি হয়, সেটা যেমন দেখার বিষয়, তেমনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে কতটুকু কার্যকর হয় সেটাও দেখার বিষয়।
উপনির্বাচনের ফলাফলকে সাধারণত খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কে জিতলো, কে হারলো তা নিয়ে সরকারেরও তেমন টেনশন থাকে না। এই জয়পরাজয়ে সরকারের টেকা, না-টেকা নির্ভর করে না। কিন্তু বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোর উপনির্বাচন কিছুটা আলাদা তাৎপর্য পাবে এ কারণে যে এতে জোটের শরিকদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মনোভাব কিছুটা হলেও বোঝা যাবে।
সরকার বা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে যে ছাড় দেবে না সেটা পরিষ্কার। কিন্তু বিএনপি কি তার অবস্থান দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পেরেছে? তিন মাস ধরে বিভাগীয় ১০ সমাবেশ ঘিরে বিএনপির মধ্যে চাঙা ভাব তৈরি হয়নি, তা বলা যাবে না। ঢাকার বাইরের ৯টি সমাবেশের পর ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ধরেই বিএনপি এগিয়েছে। অনেকদিন ধরেই আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ মনোভাবের কথা বলে আসছে। সরকারকে আর ছাড় দেওয়া হবে না। সরকার পতন না করে তারা ঘরে ফিরবেন না। সিনিয়র নেতাদের এমন বক্তব্যে প্রাণ ফিরে পায় মাঠের নেতাকর্মীরা। মামলা হামলার ভয় উপেক্ষা করে তারা সরব থেকেছেন রাজপথে। রক্ত ঝড়িয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা কেটে যাওয়ার লক্ষণ দেখে মনোবল ফিরে পেয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। সমাবেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীনদের। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশে কী দিক-নির্দেশনা পেয়েছেন নেতাকর্মীরা? কি অর্জন হলো বিএনপির? এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে জোর আলোচনা।
বিশ্লেষকদের মতে, সমাবেশের আগে বিএনপির যে হুংকার দেখা যায়; বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং সমাবেশের আগের দিন থেকে দলটির নেতাদের মধ্যে নমনীয় ভাব দেখা যায়। সরকারের সঙ্গে তলে তলে সমঝোতার আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর সমাবেশ থেকে যে কর্মসূচি দেওয়া হয়; তা হতাশ করেছে সারাদেশের কর্মীসমর্থকদের।
১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি নেতারা কর্মীসমর্থকদের মধ্যে যে চাঙা ভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ১০ ডিসেম্বর তা ধরে রাখতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বরং সাধারণ মানুষ এটাই মনে করছে, বিএনপি যা বলে তা করতে পারে না। সরকার কঠোর অবস্থানে থাকায় বিএনপি হয়তো পরিকল্পনা মতো আগ্রসর হতে পারেনি। এরপর বিএনপি কোন কৌশল গ্রহণ করে এবং মিত্ররা বিএনপির পাশে কতটা শক্তি নিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিএনপি ২০-দলীয় জোট ভেঙে আরো অনেক জোট গঠন করে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে এটা বোঝাতে চায় যে সরকারবিরোধী সব দল আন্দোলনের মাঠে আছে। তবে জোট বা দলের সংখ্যা দিয়ে কি মানুষের মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যাবে? ২০ দল থেকে ৩৩ দল কিংবা একজোট থেকে তিন জোট হলেও কি বিএনপির অবস্থান সুবিধাজনক বলা যাবে?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম