ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্বাগত ২০২৩

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট নির্বাচন

ড. হারুন রশীদ | প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ০১ জানুয়ারি ২০২৩

 

মহাকালের অমোঘ নিয়মে কালের গর্ভে হারিয়ে গেলো আরও একটি বছর। শুরু হয়েছে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। নানা দিক থেকেই ২০২২ সালটি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। জাতীয় জীবনে একাধিক বড় অর্জন রয়েছে এবছর। দেশীয় অর্থায়নে ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দৃঢ় সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক এই সেতু। কর্ণফুলী টানেলের উদ্বোধন হয় এ বছর। দেশে এ ধরনের টানেল এটিই প্রথম। এ বছর মেট্রোরেলের যুগেও প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ২৮ ডিসেম্বর দেশে প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণপরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে-এই মেট্রোরেল।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে আসে। বাংলাদেশ নজিরবিহীন ডলার সংকটে পড়ে। এতে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়। ফলে দ্রব্যমূল্যও বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিক। করোনা মহামারির তাণ্ডব কমে এলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু বছরজুড়েই চোখ রাঙিয়েছে। ২০২০ এর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। শুধু প্রাণহানিই নয় ভাইরাসকেন্দ্রিক নানা দুর্ভোগ বছরজুড়েই ভুগিয়েছে, যা এখনো চলমান।

শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে পাঠ্যপুস্তক দিবস পালন করা হচ্ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক অনৈক্য, সংঘাত, সহিংসতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস এক প্রধান সমস্যা হিসেবেই এখানে রয়ে গেছে।

রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির সহাবস্থান সম্ভব নয় বলেই এই সংকট দূর হচ্ছে না- এমনটিই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এছাড়া জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বার বার। হুমকি আসছে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষদের ওপর। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ভাবিয়ে তুলছে। এসব সমস্যা উজিয়ে একটি আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছাতেই হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। সরকার জনপ্রত্যাশা পূরণে কাজ করুক এবং ২০২৩ সাল সবার জন্য মঙ্গলময় হোক এটাই কাম্য।

দুই.
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। করোনা মহামারিও থেমে নেই। খাদ্য সংকট, অর্থনৈতিক মন্দাসহ দেখা দিচ্ছে নানামুখী সংকট। বিশেষ করে চাকরির বাজারে বইছে মন্দাবস্থা। যেখানে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রয়োজন সেখানে লোকজন চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় চাকরির প্রবাহ ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রতি বছর যে হারে শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী তৈরি হচ্ছে সে হারে চাকরির ক্ষেত্র ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমন্বয় থাকতে হবে। নইলে এক পাহাড়সম সমস্যা তৈরি হবে। আদতে হয়েছেও তাই। চাকরি প্রার্থীর তুলনায় সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে চাকরির সংখ্যা খুবই কম, যা রয়েছে সেগুলোতেও যদি নিয়ম মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রাখা না হয় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, একদিকে পাহাড়সম বেকারত্ব বাড়ছে অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে হাজার হাজার শূন্যপদ থেকে যাচ্ছে। এগুলোতে নিয়োগের যেন কোনো তাগিদ নেই। এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় দিনের পর দিন বন্ধ থাকছে শূন্যপদে নিয়োগ। এতে বেকারত্বের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হচ্ছে আকাশ-বাতাস। সময় মতো চাকরি-বাকরি না পেয়ে অনেকেই গ্লানিময় জীবন যাপন করছে, যা কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে কোটি কোটি হাত বসিয়ে রেখে সেটা সম্ভব নয়।

যেখানে দিন দিন বেকারত্ব বাড়ছে সেখানে অনেক পদ দীর্ঘদিন খালি থাকা সে অনুযায়ী নিয়োগ না দেওয়া রীতিমতো অন্যায়। যে কোনো ক্ষেত্রে শূন্যপদের নিয়োগ দ্রুততর করতে হবে। এতে একদিকে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে অন্যদিকে শূন্যপদ থাকার কারণে কাজের যে ক্ষতি হচ্ছে সেটিরও সমাধান হবে। ঠিক থাকবে চাকরির প্রবাহও। এ ব্যাপারে নতুন বছরে নতুন কিছু দেখতে চান চাকরিপ্রত্যাশীরা।

তিন.
মাদক নির্মূলে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকলেও কমছে না এর বিস্তার। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য এবং বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন মাদককারবারের সাথে জড়িত। তারা বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। সত্যি বলতে কি দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ।

মাদকের রয়েছে বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে। রাজধানীতেও মাদকব্যবসা রমরমা। মাদকের জগতে এক সময় ‘হেরোইন’ নামক মরণ নেশা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। এ পদার্থটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি খুব দামি বলে পরবর্তী সময়ে এর স্থান দখল করে নেয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বর্তমান নেশাসক্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ দুটি নেশাদ্রব্য বেশি জনপ্রিয়। একে ঘিরে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। ফেনসিডিলের চেয়ে ইয়াবাই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ সমাজের প্রতি। বেকারত্বও মাদকের বিস্তারে সহায়ক-এমন কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা। এই মরণ নেশার বিস্তারে সমাজে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটি সমাজের অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে মধ্যে ছোটখাটো মাদক কারবারি ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। সেজন্য আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

মাদকের সর্বনাশা দিক নিয়ে অনেকবারই লিখেছি। কিন্তু অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। যারা ইতোমধ্যে মাদকাসক্ত হয়েছে তাদেরও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়াতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যাও। সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। নতুন বছরে নতুন করে শপথ নিতে হবে।

চার.
চলছে শীতকাল। শীতের হিমেল হাওয়া আর কুয়াশায় সূর্য যেন অনেকটাই কাবু। তাই সূর্যের দেখা মেলা ভার। শীতে কাঁপছে দেশ। উত্তরাঞ্চলে হিমালয়ঘেঁষা জেলাগুলোতে শীতের প্রভাব বেশি। সামনে মাঘ মাস। কথায় আসে এক মাঘে শীত যায় না। কিন্তু পৌষেই তো জড়োসড়ো অবস্থা। মাঘ এলে যে কী হবে সেটি লেখাই বাহুল্য।

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ঋতুর পরিবর্তন হবে। এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য প্রতিটি ঋতুই যেন উপভোগ করা যায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। শীতজনিত রোগব্যাধি থেকে মানুষজনকে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখতে হবে। তীব্র শীতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য গরম কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

শুধু সরকার নয় সমাজের বিত্তবানরা এ জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। কবি সুকান্ত যেমন করে সূর্যের কাছে উত্তাপ চেয়েছিলেন ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটির জন্য’ তেমনিভাবে আমাদের মধ্যে এই শীতে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। আর তখনই শীত কষ্টের ঋতু না হয়ে উৎসবের ঋতু হয়ে উঠবে।

পাঁচ.
২০২২ এ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসর বসে। প্রথমবারের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে অনুষ্ঠিত এই বিশ্ব আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা। বছর শেষে এসে ফুটবল সম্রাট পেলের মৃত্যু কাঁদিয়েছে বিশ্ববাসীকে।

ছয়.
বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক অনৈক্য, অস্থিরতা এখনো সংকটের বড় কারণ। বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক বিষয়গুলো এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। দুর্নীতি পাহাড় সমান। ব্যাংকের অর্থ লুট, টাকা, পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ ঘটছে। এগুলোর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। তাই রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এখন স্মার্ট বাংলাদেশ স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য চারটি ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকটা সিটিজেন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ ইকোনমির সব কার্যক্রম আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে করবো ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট যেটা ইতোমধ্যে আমরা অনেকটা করে ফেলেছি, বাকিটাও করে ফেলব এবং আমাদের পুরো সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি।'

আসলে সবার আগে প্রয়োজন একটি স্মার্ট জাতীয় নির্বাচন। যেটি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তাহলেই সম্ভব সত্যিকারের স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস