রংপুর যে বার্তা দিল
বছর শেষের সন্ধ্যা নামবে আজ। এক বছরের ভালো-মন্দ, প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তির ভর্তি অথবা শূন্য থালা নিয়ে সামনের দিকে চাইবে মানুষ। শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা, এরপরই সশব্দে বর্ষবরণের নাচ-গান-আলো খুবই জমকালো, হইচই হট্টগোলময় হয়ে উঠবে রাজধানীসহ দশের নানা প্রান্ত। কিন্তু ইংরেজি নববর্ষ পালনের এই পশ্চিমা ধারার আয়োজন সবার জীবনে আসেনা। দেশের বড় অংশের মানুষই আরও একটি সাধারণ দিন বা রাতের মতোই পার করবে আর জীবনের লড়াইয়ের কথা ভাববে।
বছরের শেষ সময়ে, ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন যা আপাতত চলবে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁ পর্যন্ত। মানুষের উচ্ছ্বাস দেখছি আমরা এবং সেটি চলবে আরও কিছুদিন যেমনটা দেখেছিলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পরও। আরও শত শত সড়ক আর অবকাঠামো এ বছরটিতে চালু করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকার, অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজ, থিঙ্ক ট্যাংক থেকে শুরু করে সচেতন জনগণের মধ্যে বেশ উদ্বেগ ও শঙ্কা ছিল বছরজুড়েই এবং সেটা এ সময়ে এসে আরও ঘনীভূত হয়েছে। কৃষি খাতের সাফল্যে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ অবস্থা সৃষ্টি হয়নি যদিও অনেকেই শ্রীলংকার পরিস্থিতি দেখে নানা আশংকা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে ব্যাপক হারে দেশ থেকে অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে জালিয়াতি ও দুর্নীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর প্রবল চাপ এবং ব্যাংক সমূহের মাধ্যমে এলসি খোলার সঙ্কট বড় আলোচনা ছিল বছরটিতে। বড় আলোচনা থেকেই গেল জ্বালানি স্বল্পতার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়। চরম মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে যে সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে সেটি থেকে নতুন বছরে মুক্তি মিলবে কিনা সেটার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে আমাদের।
রাজনীতির মাঠ বরারবরই উত্তপ্ত ছিল। তবে বছর শেষে শাসক দল আওয়ামী লীগ রংপুর সিটি নির্বাচনে যে বার্তা পেয়েছে সেটি দলের নীতি নির্ধারকরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন তা দেখার বিষয়। রংপুরে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে হারিয়ে দিবে সেটা কেউ কল্পনা করেনি। কিন্তু নৌকা এমনভাবে পরাজিত হবে, এতটা বিদ্ধস্ত হবে, সেটাও কল্পনার বাইরে ছিল। দ্বিতীয়বারের মতো রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান।
ফলাফলে দেখা যায়, লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী (হাতপাখা প্রতীক) আমিরুজ্জামান। তিনি পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) লতিফুর রহমান ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা (ডালিয়া) ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন এবং জামানত হারিয়েছেন।
কেন এমন হল? ডালিয়ার যে কোন জনভিত্তি নেই, এই নির্বাচন সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় নেতারা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতারা ভুল প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। কেউ কেউ মনোনয়ন দুর্নীতির দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। তবে ভোটের হিসাব কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী আর আসল প্রার্থী মিলে যে ভোট পেয়েছেন তা আগেরবারের ভোটের চেয়ে কম। জাতীয় পার্টি জিতলেও তার ভোট কমেছে। বেড়েছে কেবল হাতপাখার ভোট। দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে এবার।
আমরা অনেকদিন ধরেই দেখছি স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল, বিবাদ, সহিংসতা, অরাজনৈতিক চর্চা ও আচরণ দলটির অবস্থান নাজুক করে তুলেছে। সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের বার্তার চেয়ে দলের ভেতরকার বিদ্বেষ আর বিভাজন, সহিংসতা মানুষ এবং ত্যাগী কর্মীদের থেকে অনেকখানি সরিয়ে নিয়েছে যেন দলকে। কান পাতলেই শোনা যায় অনেক বিবাদের খবর। দলের নেতা কর্মীরাই বলেন- একটি সেয়ানা, লোভী, কৌশলী, সুযোগলোভী, সুবিধাভোগী উপমধ্যশ্রেণি জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় দখল করে নিয়েছে দলকে। তারই কী খণ্ডচিত্র রংপুর সিটিতে দেখা গেল? সেটা দলই ভাল করে বলতে পারবে, যদি দেখার চোখ আর শোনার মন থাকে।
কে কীভাবে রাজনীতি করবেন সেটা নিশ্চয় ঠিক করার অধিকার রাজনীতি যারা করেন তাদেরই। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে যখন সেটা একটা ধারার চেহারা নেয়, তখন তা ব্যক্তি বা দলের সীমা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাঠ্যবস্তু হয়ে ওঠে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দলীয় অন্তঃকলহপূর্ণ রাজনীতির সাক্ষী হয় কেবল জনগণ যাদের কিছু করার থাকেনা।
রাজনৈতিক দল রাজনীতি বাদ দিয়ে ক্ষমতা, পেশির প্রদর্শন করলে, কোন্দলের গান গাইলে কী হয় সেটা রংপুর শুধু নয়, সারাদেশেই বোঝা যাচ্ছে। ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি। এসব কারণে স্বাভাবিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সরকারি দল বা বিরোধী দল, আমাদের পুরো রাজনীতিই সামগ্রিক ভাবে তার প্রকরণে, অনুশাসনে, কৌশলে এবং মূল্যবোধে একটা বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানা দলীয় কার্যকলাপের মধ্যে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। সর্বত্র একটি আগ্রাসী চেহারা। রাজনীতির মধ্যে পারফরম্যান্সের একটা বড় ভূমিকা বরাবর থেকেছে। ভালো সংগঠক, ভালো কৌশলী, ভালো বক্তা, ভালো তাত্ত্বিক, ভালো প্রভাব— এ সবই দলের সম্পদ। এই নির্বাচনী বছরে আওয়ামী লীগ ভেবে দেখতে পারে তার জনপ্রতিনিধিরা যথেষ্ট ভাল পারফর্ম করেছেন কিনা।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস