ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সরিষা চাষের সফলতা ও ভোজ্যতেলের চ্যালেঞ্জ

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক হতাশার কথা থাকলেও আমি দিনশেষে আশাবাদী হয়েই বাঁচি। আমার দেশ, আমার মাটি কখনও আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। যখন যা চাই তা হয়তো সহজে পাই না কিন্তু দেশের প্রতি প্রত্যাশার সবটা একসাথে না হলেও কখনও আশাহত হতে দেয় না। সয়াবিন তেলের সংকটে যখন আমরা দিশেহারা। বাজারে তেল সংকট। মজুতদারদের সিন্ডিকেশন। টাকা থাকলেও তেল না পাওয়া আবার বেশিরভাগ মানুষের সামর্থ্য হয়তো কমে যাচ্ছে চাহিদা মোতাবেক তেলের জোগাড় করতে করতে।

দেশে দৈনিক ভোজ্যতেলের চাহিদা ৫ হাজার ৪৭৯ মেট্রিক টন। এই বিপুল চাহিদার পুরোটাই আসে দেশের বাইরে থেকে। কাঁচামালের বিদেশনির্ভরতা আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানোয় সরকারকে টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। সামর্থ্য থাকলেও তেল পাচ্ছে না আবার সামর্থের অভাবে ন্যূনতম তেলটাও জুটছে না এমন অবস্থায় যখন সংবাদ ছাপা হয় যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে কৃষকরা সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকছে এবং প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলাফল পাচ্ছে, তখন আশাবাদী হবো না তো কী?

আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু সরিষা তেলের ব্যবহার দেখেছি। সয়াবিনের প্রচলন থাকলেও সেটা ছিল মোটামুটি সামর্থ্যবানদের ঘরের বিষয়। আমাদের বাসায়ই আমরা পাম ওয়েলের ব্যবহারও দেখেছি। আমার আব্বা ঢাকা থেকে বাসায় যাওয়ার সময় প্রতি মাসে একটা করে সাদা পামওয়েলের বয়াম নিয়ে যেতেন। তখন সদ্য বাংলাদেশের বাজারে পামওয়েলের আগমন। তবে সেটাও ব্যবহার করা হতো বিশেষ রান্নায়। পরোটা ভাজায়। ধীরে ধীরে সয়াবিন তেল সবার রান্নাঘর দখল করে নিলো। সরিষা তেল হয়ে গেলো শখের পণ্য। ভর্তাকেন্দ্রিক স্থায়ী হলো এর ব্যবহার।

তবে এটা ঠিক যে সরিষা তেল সয়াবিনের চেয়ে খারাপ এমন কোনো গবেষণার ফলাফলে আসেনি। শুনেছি সরিষা তেল সয়াবিনের মতো হৃদরোগের কারণ হয় না। সরিষা তেলের দাম এখন একটু বেশি কিন্তু এর পরিমাণ রান্নায় সয়াবিনের মতো বেশি লাগে না। আবার অন্যদিকে সরিষা তেলের জোগানও কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে বীজের চাহিদা বা অন্যসব প্রয়োজন মেটানোর পর প্রায় ৫ লাখ টন সরিষা ব্যবহার হয় তেল উৎপাদনের জন্য।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবার সরিষার বাম্পার ফলনের সংবাদ অবশ্যই আমাদের আশাবাদী হতে সাহায্য করছে। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন, সংকট মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য। ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে কৃষকদের এই আগ্রহকে চাইলেই আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি।

কুমিল্লার দক্ষিণে এবার দ্বিগুণ সরিষা চাষ হয়েছে। অনেকেই মাছ চাষের বদলে সরিষা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরিষা চাষের মাধ্যমে তারা তাদের দৈনিক তেলের চাহিদা মেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সয়াবিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন এবং এর উত্তরণের পথ হিসেবেই এই পথে আসা। আবার অন্যদিকে সরিষা চাষে খরচ কম, কষ্টও কম। কেবল আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেই সরিষায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব এখানে কম।

স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তর এইক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক একটি বিষয়ের কথাও বলছেন। কেবল কুমিল্লা নয়, ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে হিলিতে দ্বিগুণ সরিষার চাষ হচ্ছে বলেও সংবাদ এসেছে। শীতকালে মাছের বৃদ্ধি কম হয় তাই মাছ চাষ বন্ধ রেখে এই মৌসুমে সরিষা চাষ করছে কৃষকরা। সরিষার চাষ হয় কেবল শীতকালেই। তাই প্রয়োজনে বছরের বাকি সময়ে এসব জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার কতটা কীভাবে করা যায় সেটিও ভেবে দেখা যেতে পারে।

আমাদের কৃষিমন্ত্রী তার এক সাক্ষাৎকারে কিছুদিন আগে একই কথা বলেছেন। ৯০ শতাংশ তেল রপ্তানিতে আমাদের একটি বৃহৎ অংকের ডলার খরচ হয়। বাকি ১০ শতাংশ সরিষা, রাইস ব্রান, সূর্যমুখী ইত্যাদি চাষকেও কতটা আরও বাড়ানো যায় সেটিও তিনি ভেবে দেখার কথা বলেছেন। আমার বিশ্বাস, আমাদের কৃষকদের প্রাকৃতিক শিক্ষা এতোটাই আশাব্যঞ্জক যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তাদের আরও আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানের মাধ্যমে সাহায্য করা যাবেই। এখন যারা নিজের অর্থে এই কাজটি করছে সরকারের প্রয়োজন নিজের স্বার্থেই এগিয়ে এসে এই উৎসাহকে পুঁজি করা।

আমাদের দেশের মানুষের এই যে মাটি থেকে পাওয়া সমস্যা মোকাবিলার সাহস, এটিই হচ্ছে আমাদের অন্যতম সম্পদ। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে কেবল এই সাহসকে বুকে নিয়েই। নিরস্ত্র মানুষগুলোর যদি সেদিন লড়াই করে জিতে আসার মনোভাবটা না থাকতো তাহলে পাকিস্তানির সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, বল্লম নিয়ে যুদ্ধের কথা চিন্তাই করতো না।

হাজারও, লাখো সমস্যার মাঝেও এগিয়ে চলেছি আমরা এই প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের ভরসায়ই। অনেক প্রতিকূলতাও আমাদের নোয়াতে পারে না। নাহলে বছরে একবার করে বন্যা, খরায় ভোগা মানুষেরা আবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইতো না। আইলা, সিডরের মতো দুর্যোগকে জয় করে আমরা টিকে আছি। এই তো বেশিদিন আগের কথা নয়, ২০২০ থেকে যখন গোটা বিশ্ব করোনায় গৃহবন্দি, আমরা তখন ভয়কে জয় করে মোকাবিলা করেছি। না খেয়ে মরতে হয়নি একজন মানুষকেও। এই সাহস আমাদের জন্মগত। এই সাহসকে কদর করতে যে জানবে সেই এই বাংলাদেশকে বুঝতে পারবে আর সেই নেতার হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ।

দিনশেষে আমি আশাবাদী। আবারও স্বপ্ন দেখি আমাদের নেতারা এই প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিক পথে পরিচালনা করে সব সংকট মোকাবিলা করে বিশ্বদরবারে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একদিন ভোজ্যতেলের অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে বিশ্ব সংকট মেটাতেও সহায়তা করতে পারবো।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন