যে কারণে মেট্রোরেলের ভাড়া কমানোর দাবি
রাজধানীর প্রায় দুই কোটি মানুষের নিত্যদিনের ভোগান্তির নাম গণপরিবহন। সিন্ডিকেটের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নগরীর গণপরিবহন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার রাজধানীবাসীর জন্য মেট্রোরেল চালুর উদ্যোগ নেয়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসেন খালেদা জিয়া, আর আলোর মুখ দেখেনি মেট্রোরেল প্রকল্পের ফাইল। ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার মেট্রোরেল নিয়ে কাজ শুরু করে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২৯ ডিসেম্বর চালু হচ্ছে মেট্রোরেল। উন্নয়নের ধারায় আরও একধাপ এগিয়ে গেলো দেশ। মেট্রোরেল আমাদের দেশে নতুন, পাশের দেশ ভারত এবং পাকিস্তানে অনেক আগেই চালু হয়েছে। রাজধানীর প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রতীক্ষায় রয়েছে কবে চালু হবে তাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল। অবশেষে এই বিজয়ের মাসে চালু হচ্ছে মেট্রোরেল। কিন্তু ভাড়া নিয়ে বিপত্তিতে পড়েছে নগরবাসী। নির্ধারিত ভাড়ায় তাদের আপত্তি।
ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে যাত্রীসাধারণের মতামত ও কোনো প্রকার পর্যবেক্ষণ করেনি কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর গণপরিবহনের দ্বিগুণ হারে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। এতে জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ঢাকা ও কলকাতা শহরের আর্থসামাজিক অবস্থা, মাথাপিছু আয় ও গড় জিডিপি আয় বিবেচনায় নিলে প্রায় সব সূচকে সমান অবস্থানে থাকলেও কলকাতার মেট্রোরেলের তুলনায় ঢাকার মেট্রোরেলে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া দ্বিগুণ ধরা হয়েছে।
এতে যাত্রীস্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বেসরকারি লক্কড়-ঝক্কড় বাস কোম্পানিগুলো লাভবান হবে, সামর্থ্যহীন যাত্রীসাধারণ মেট্রোরেল ব্যবহারের সক্ষমতা হারাবে। ফলে মেট্রোরেলে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। অন্যদিকে জনমনে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়বে।
ভারতের কলকাতায় মেট্রোরেলের ভাড়া সড়ক পরিবহনের তুলনায় সবচেয়ে কম, সেটা কলকাতা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট উল্লেখ করে রেখেছে। কলকাতায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি বা ৬ টাকা। আর ঢাকায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা।
কলকাতায় মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ভাড়া ২৫ রুপি বা ৩১ টাকা। ঢাকায় মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা। কলকাতায় ৫ রুপি বা ৬ টাকা দিয়ে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়, ১০ রুপিতে ৫ কিলোমিটার, ১৫ রুপিতে ১০ কিলোমিটার, ২০ রুপিতে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ রুপি বা ৩১ টাকা লাগে।
বাংলাদেশে উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা, যা কলকাতার মেট্রোরেলের চেয়ে ৪ গুণ বেশি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির মেট্রোতে একই দূরত্বে ৪০ রুপি বা ৫০ টাকা লাগে, যা ছুটির দিনে ৩০ রুপিতে নেমে আসে। দিল্লির মেট্রোতে ৩২ কিলোমিটার পথে ৬০ রুপিতে যাতায়াত করা যায়।
অপরদিকে, পাকিস্তানের লাহোরে অরেঞ্জ লাইন মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া পাকিস্তানি ২০ রুপি বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৯ টাকা। ২৭ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ৪০ রুপি বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৮ টাকা লাগে। লাহোরের মেট্রোতে প্রথম ৪ কিলোমিটার ২০ রুপি বা ৯ টাকা। ৫ কিলোমিটার থেকে ৮ কিলোমিটারের জন্য ২৫ রুপি বা ১১ টাকা, ৯ থেকে ১২ কিলোমিটারের জন্য ৩০ রুপি বা ১৪ টাকা লাগে। ১৩ থেকে ১৬ কিলোমিটারের জন্য ৩৫ রুপি বা ১৬ টাকা লাগে।
১৬ থেকে ২৭ কিলোমিটারের জন্য ৪০ রুপি বা ১৮ টাকা লাগে। আগে লাহোর মেট্রোতে যেকোনো দূরত্বে যাতায়াতের জন্য ৪০ রুপি বা ১৮ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ যাত্রীই পুরো ২৭ কিলোমিটারের বদলে প্রথম ১৬ কিলোমিটার অংশে যাতায়াত করেন। তখন মেট্রো কর্তৃপক্ষ যাত্রী সাধারণের সুবিধার্থে এভাবে প্ল্যানভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করেন।
কলকাতা ও দিল্লি মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় কম হওয়ায় এসব রেলে ভাড়াও কম। এ দুটি রেল নির্মাণে ঢাকা থেকে বহুগুণে কম ব্যয় হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে নির্মিত ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার নর্থ-সাউথ মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে নির্মিত ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরে লাইন-২ এ মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ভারতের দিল্লি লাইন-১ মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে নির্মিত পাকিস্তানের লাহোর অরেঞ্জ মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ ৬ কোটি ৬১ লাখ ডলার।
অপরদিকে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তরা থেকে কমলাপুর ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের পরিবর্তে কেন এত উচ্চমূল্যে মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হচ্ছে দেশবাসী তা জানতে চায়।
সরকার তো সব ক্ষেত্রেই ভর্তুকি দিচ্ছে, মেট্রোরেলে ভর্তুকি দেয়ার তো প্রশ্ন আসছে না। খরচ তুলে নেওয়ার সময়টা কয়েক বছর বাড়িয়ে নিতে আপত্তি কোথায়। শুধু যোগাযোগ সহজ করলেই তো হবে না। মানুষের ব্যবহারের সক্ষমতাও তো বিবেচনায় নিতে হবে। যে নগরবাসীর জন্য এই বিপুল ব্যয়, যাতায়াত সহজ করতে এতো উদ্যোগ, তা যদি তারা ব্যবহারের সক্ষমতা হারায় তাহলে তো মূল উদ্দেশ্যই বিফলে যাবে। দেশবাসী আশা করছে শেখ হাসিনার সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম