ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সোনার পাথরবাটি ও সুনাগরিক তস্কর

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২

চুরি করতে গিয়ে এক চোর বন্দি হয়ে পড়েছে দোকানে। কোনোভাবেই বাইরে বের হতে পারছে না সে। বের হয়ে ধরা পড়লেই তার পিঠের চামড়া অক্ষত থাকবে না। তার সঙ্গে আছে মোবাইল ফোন। হঠাৎ বুদ্ধি হলো ৯৯৯-এ ফোন করার। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য চোর পুলিশকে ফোন করলো।

বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের এর আর খান বাজারের এক মুদি দোকানে চুরি করতে গিয়ে চোর ভেতর থেকে বের না হয়ে পুলিশকে জরুরি নম্বরে কল দিয়েছিল। বহুদিন ধরে চুরি করা তার বৃত্তি। চুরি করার আয়-উপার্জন দিয়ে তার সংসার চলে।

বন্দর থানার ওসি সাহেব ৯৯৯ থেকে ফোন কল পেলে চোর তাকে পরিচয় গোপন রেখে জানায় তিনি খুব বিপদে আছেন। তাকে দ্রুত বিপদ থেকে উদ্ধার করা হোক। ওসি সাহেব ডিউটি কর্মকর্তাকে বলেন, একজন সম্মানিত সিটিজেন বিপদে পড়েছেন। তখন একদল পুলিশ পাঠিয়ে তাকে দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়। তিনি কেন দোকানে ঢুকেছেন? দোকান থেকে বের হতে তার অসুবিধা কোথায় জিজ্ঞেস করা হলে চোর জানায় তিনি অতি ভোরে চুরির উদ্দেশ্যে দোকানে ঢুকেছেন। কিন্তু ব্যাগে মালামাল ভর্তি করতে দেরি করে ফেলায় সকাল হয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে দোকানের সামনে লোকজন চলাচল করছে। তাই ব্যাগ নিয়ে বের হতে গেলে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তাই নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে ফোন করেছেন। তবে মালামালের ব্যাগ দেখে সন্দেহ হওয়ায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেছে। পরে চুরির মামলা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এমন বুদ্ধিমান চোরের কথা শুনে সবাই বেশ অবাক হয়ে গেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

কথা হলো- এমন বুদ্ধিমান নাগরিক দেশে থাকলে চুরি করতে গিয়ে বিপদের কিছু ঝুঁকি আছে কি? আজকাল চোরের কত ধরন, কত রকমফের সৃষ্টি হয়েছে তা চারদিকে একটু তাকালেই আঁচ করা যায়। পুলিশ সবার বন্ধু। যে কোনো নাগরিক বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধার করা পুলিশের দায়িত্ব। সে যেই হোক না কেন- জীবন রক্ষা করাটা সবার আগে বর্তায়। মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য পুলিশের চমৎকার তৎপরতা এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বিপদের সময় পুলিশের দ্রুতবেগে উপস্থিতি ও সেবা দান করার মানসিকতা এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

তবে অন্যান্য অনেক ঘটনায় নিজেদের চেনা সোর্সের সংকেত ছাড়া পুলিশকে এত দ্রুত অকুস্থলে হাজির হতে দেখা যায় না। এখানে কি সোর্সের কাছে কিছুই জানতে চাওয়া হয়নি? অথবা চোর নামক সম্মানিত নাগরিকের ফোন নম্বরটি আগে থেকেই জানা ছিল? কোন এলাকার সব চোর-ডাকাত সম্পর্কে তথ্য তালিকা সব জায়গার গোয়েন্দা নজরদারিতে সাধারণত জানা থাকে। এক্ষেত্রে কি তার কোনো যোগসূত্র ছিল? এগুলো পাঠকরা আলোচনা করেছেন নানাভাবে।

মানুষ যেন পুলিশের কাছে যেতে চায় ও আশ্রয় পায় তার জন্য একাগ্রচিত্তে সবাইকে কাজ করতে হবে। সম্প্রতি নতুন আইজিপি মহোদয় তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘মানুষ যেন নির্ভয়ে তাদের সমস্যার কথা বলতে পারে সেজন্য থানা জনগণের আস্থা ও ভরসার আশ্রয় হিসেবে পরিণত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

আমাদের দেশে অনেকদিন ধরে মানুষ পুলিশের কাছে ভয়ে যেতে চায় না। তারা ভাবে পুলিশের কাছে গেলে ছোট ঘটনা আরও অনেক বড় ও জটিল আকার ধারণ করে। সেখানে কাঁঠালের আমসত্ত্ব বা সোনার পাথরবাটি খুঁজে বেড়াতে গিয়ে জটিলতার অবসান হতে প্রচুর সময় ক্ষেপণ করা হয়। এতে একজন ভিকটিম সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এসব ঝামেলা এড়াতে গিয়ে কেউ কেউ নিজের কোনোকিছু চুরিজনিত সমস্যার কথা সরকারি খাতায় জানানোর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এভাবে দেশে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য আরও বেগবান হয়। অপরাধীরা পুলিশকে ভয় না পেয়ে সবার চোখের সামনেই ঘুরে বেড়ায়।

একজন সাধারণ মানুষ যেখানে পুলিশকে ফোন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন অথবা ভয় পেয়ে এড়িয়ে চলেন সেখানে একজন পেশাদার চোর মুদি দোকানে ব্যাগে মালামাল ভর্তি করে পালানোর সহজ উপায় না পেয়ে সাতপাঁচ না ভেবে পুলিশের সাথে হটলাইনে যোগাযোগ করেছে- সেটাই বড় বিস্ময়ের ব্যাপার।

এতে মনে হয় আমাদের দেশে পুলিশের ওপর সাধারণ বা নিরীহ মানুষের না হোক কিছু মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে গেছে। নাগরিক সেবা দিন দিন সবার জন্য সহজ হয়ে যাচ্ছে এবং চোররা ভদ্র ও সুনাগরিক হচ্ছে। তারা ডিজিটাল পদ্ধতির আধুনিক সেবাকে নিজেদের ঘৃণ্য পেশায় ব্যবহার করতে সাহস পাচ্ছে। চোরের এত সাহসকে দুঃসাহসই বলা যেতে পারে।

এতো গেল সামান্য ছিঁচকে চোরের ঘটনা। চোরের প্রকারভেদ ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এখন বিশ্বব্যাপী। তাদের দাপট সমাজের ঘাস পর্যায় থেকে বিলাসী আকাশচুম্বি অট্টালিকার চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। সোনায় মোড়ানো রোলসে রয়েস গাড়ির মালিক থেকে সোনার টয়লেট ব্যবহারকারী মহাশক্তিধর মাফিয়াদের নেটওয়ার্ক পর্যন্ত বিরাজমান।

সেসব চোরদের হটলাইন ফোনগুলো আরও বেশি গতিসম্পন্ন। তাদের কাজ কারবারে বিপদ ঘটলে সেসব ফোন থেকে কল চলে যায় বিগবস ও আসল মাফিয়া ডনদের কাছে। তখন একদল পুলিশও পাঠানোর দরকার হয় না তাদের উদ্ধার করতে। যে কোনো ক্ষুদ্র বায়বীয় সংকেতই যথেষ্ট তাদের বিপদ কাটানোর জন্য। সেসব চোর কখনও আত্মসমর্পণ করে না। বরং ভয় দেখিয়ে কাজ উদ্ধার করে।

সে ভয়টা প্রথমত লোভ দেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাতে কাজ না হলে লোভের সাথে লাভের অংক ধরিয়ে দেওয়ার প্রলোভন শুরু হয়ে। আর এতেই বহুলাংশে কার্যোদ্ধার হয়ে যায়। এভাবে মাদক, মুদ্রা, স্বর্ণ, ইউরেনিয়াম, জাল নথি, দলিল, জাল প্লট ইত্যাদির অবৈধ ব্যবসা জিইয়ে থাকে সেসব বিগ চোর-ডাকাতদের একহাত থেকে আরেক হাতে, ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে, বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। যার কখনও ইতিবাচক সমাধান বা সমাপ্তি ঘটতে দেখা যায় না।

কারণ, এসবের সমাধান হলে একজন ছিঁচকে চোর পেটের দায়ে মুদি দোকানের সাটারের মধ্যে নিজে থেকে আটকা পরার নাম করে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে হটলাইনে ফোন করতে সাহস করতো না। আর কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানিয়ে কেউ ভেজালের ব্যবসায় নেমে পড়তো না। অথবা তামা বা পাথরে সোনালি প্রলেপ দিয়ে ভেজাল সোনার বাটি বানিয়ে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে জিনের ব্যবসা করতো না।

কথা হলো পুলিশ সবার বন্ধু-এটা খুব ভালো একটা ধারণা। এজন্য তাদের ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়’ -এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই মুদি দোকানে চুরি করতে যাওয়া চোরের মতো সব বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারে তৎপরতা দেখাতে হবে সবসময়। এভাবে পাপকাজকে ক্রমাগত ঘৃণা করলে দেশে কোন স্তরে কোথাও কেউ চুরি করতে চাইবে না। সমাজ হবে চোর-ডাকাত মুক্ত একটি পবিত্র অঙ্গন।

চোর সৎ হতে পারে না। তাই চোর কারও ভালো বন্ধুও হতে পারে না। চোরের সাথে মিলেমিশে বাস করাও বিপদ। বলা হয়, চোর তার মায়ের সোনার দুল চুরি করতে গিয়ে আপন মায়ের কান কেটে ফেলতেও কার্পণ্য করে না। তাই বলা হয় চোরের কোনো ধর্ম নেই। যে চোর যত শিক্ষিত, ভদ্র ও ক্ষমতাধর সে চোরের হাত তত লম্বা।

চোরকে চিহ্নিত করে ধরে দেওয়ার তাগিদে পুলিশিংয়ের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু অসাধু পুলিশ হাত লম্বা চোরদের ভয় পায়। একটি জেলার এসপির কাছে প্রতিকার চাইতে গেলে শোনানো হয়েছে, ‘সাবধান এদের (অভিযুক্তদের) হাত অনেক লম্বা। তাদের সাথে মিলেমিশে চলেন, নইলে বিপদে পড়বেন’। সম্প্রতি একটি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় লাল শিরোনাম হয়েছে ঘটনাটি।

চোরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গেলে প্রতিকার না করে উল্টো অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগীকে সাবধান থাকতে বলাটা পুলিশের চরম দুর্বলতার পরিচায়ক। মানুষের কাছে এর অন্তর্নিহিত অর্থও ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে। এভাবে ‘অপেশাদারি কথা বলে ভিকটিমের মনোবল ভেঙে দেয় পুলিশ। প্রভাবশালী চোর ও দুর্নীতিবাজদের জন্য তাদের থাকে মায়াকান্না’। এসব অপেশাদার, দুর্বল হাত পুলিশের জন্য মাঠ পর্যায়ে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অমানুষ সেজে চোর পাপকাজ করলেও সে একজন মানুষ। সেজন্য পুলিশ একজন ‘হোমোসেপিয়েন্স’-চোরকে ধরে সহজেই সুপথে ফেরাতে পারে। এটা আধুনিক পুলিশিংয়ের তাগিদ। একজন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্ববান সৎ পুলিশ সব মানুষর সৎ বন্ধু হিসেবে যেন দ্রুত পরিচিতি পায় তার জন্য সব মানুষকে চোরের সখ্য পরিহার করতে হবে এবং চরকাউয়া ইউনিয়নের আর খান বাজারের চোরকে ধরার ঘটনাটি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য শুধু শাস্তি নয়, বরং দ্রুত নিতে হবে সব মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানানোর মহৎ কর্মপরিকল্পনা।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস