স্বাধীনতা এক জীবন দর্শন এক জীবন চর্চা
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গৌরবের দিন বিজয় দিবস। গতকাল দিনটি চলে গেছে। তবে পুরো ডিসেম্বরেই বিজয়, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা থাকে বলেই মনে করি। স্বাধীনতার চেতনা সব সময়ের প্রাসঙ্গিকতা এজন্য যে ১৯৭১ সালের আগে কিংবা পরে বাঙালির জীবনে এমন শুভ মুহূর্ত আর কখনো আসেনি। সে সময় পুরো জাতি অভিন্ন লক্ষ্যে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
এত মানুষের আত্মত্যাগ কেবলই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্যই ছিল না, লক্ষ্য ছিল একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ একটি মানুষের রাষ্ট্র হবে যেখানে পাকিস্তানি শাসনামলের সব অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটবে এবং শাসন প্রণালীতে মানুষের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে।
এত বছর পরে এসে আমরা যখন পেছনে ফিরে যাই বা বর্তমানে তাকাই, তখন কেবলই হতাশা মানুষকে আচ্ছন্ন করে। মুক্তিযুদ্ধের কোন চেতনাই এখন শাসন ব্যবস্থায়, আর্থ-সামাজিক পরিসরে মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হিসেবে নেই। এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ উন্নয়ন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন পাকিস্তানি জামানার চাইতে নিশ্চয়ই বেশি হয়েছে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গত ১৪ বছরে আরও বেশি দৃশ্যমান এই উন্নয়ন। কিন্তু দেশের উন্নয়ন মানেই যে নাগরিকের অগ্রগতি সেটা বলা যাচ্ছে না।
শুধু সেই বস্তুগত উন্নয়ন হলেই চলে না, মূল্যবোধ, চিন্তাধারার অগ্রগতিও জরুরি। সেই সূত্রে বলতে হয়, আমাদের মনোজগৎ আরও পিছিয়েছে, আরও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়েছে, আমরা বিজ্ঞান মনষ্কতা থেকে দূরে চলে গিয়েছি এবং আমরা কেবলই বিভাজিত হয়েছি। পাকিস্তানি শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার অহংকার আছে, কিন্তু নিজেরা নিজেদের যে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছি সেখান থেকে মুক্তির আলোয় আদৌ যেতে পারব কি না তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আজ অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে সহিংসতা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ঘৃণার চাষ এবং অগণতান্ত্রিক আচরণ— এরকম অসংখ্য সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খাচ্ছে।
মৌলিক জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক মতৈক্য ও অঙ্গীকার নেই। দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নেই এত বিভেদ আছে যা ভাবা যায় না। একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভীষ্টে যেতে হলে ক্ষমতার কেন্দ্রে বা ক্ষমতার বাইরে উভয় রাজনীতিতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকতে হবে। কিন্তু গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ে আমরা তা অর্জন করতে পারিনি।
গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাও বারবার ব্যাহত হয়েছে। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পেছনে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘ সময়, যা থেকে এখনও বের হওয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্বেষ আর বিভাজনের রাজনীতি চর্চায় দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে এখন প্রায় অস্তিতহীন হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে দেশে যে ১৬ বা ১৭ কোটি মানুষ আছে তার বড় অংশটিই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে মহান বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে না। কিন্তু দিনটা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয় যদি প্রত্যেক নাগরিককে এই দিনে নতুন কোনো লড়াইয়ের দিশা দেখানো যায়। সেই লড়াইটা হলো সত্য বলা, সত্যের বিরুদ্ধে কোন অবস্থানকে জোরে না বলতে পারা। পুরো নাগরিক সমাজকে ভীরু বানিয়ে রাখার মধ্যে কোনো আদর্শ বা চেতনা নেই।
যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ আজও স্বচ্ছ করতে পারিনি জনতার কাছে। স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা। জীবনযাপনের একটা বহিঃপ্রকাশ। সামাজিক ও একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের বাইরে গিয়ে এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। সামগ্রিক ভাবে মানুষের মননের কাছে এর অর্থ হলো মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করা, মুক্ত মত প্রকাশ করতে পারা। একটা ভয়ের সংস্কৃতি এসে দখলে নিয়েছে সবকিছু।
কোন কথায় কার কোন অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয় এমন ভাবনা সবখানে। নানান ভয়ের শব্দ এসে ভিড় করছে আমাদের চারধারে। এমনকি শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞানের যুক্তি পড়াতে গিয়ে ছাত্র, অভিভাবক আর মৌলবাদী মানুষের তাণ্ডবের শিকার হচ্ছেন শিক্ষকরা। স্বাধীন ভাবে বলার আগে মানুষ ভাবছে আদৌ এসব বলা বলা ঠিক হবে কি না! বললে না জানি কী বিপদ ঘনিয়ে আসবে!
এটি বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা নয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসরসহ সবকিছু সমাজবিরোধী গুন্ডা প্রকৃতির রাজনৈতিক শক্তি কিংবা উগ্র সাম্প্রদায়িক সহিংস গোষ্ঠীর হাতে আটক হয়ে আছে। সব পক্ষ থেকেই মানুষকে ভয় দেখিয়ে কণ্ঠ রোধ করে দেওয়াটা ক্রমশ একটা প্রচলিত ধারা হয়ে উঠছে। আর মানুষও এতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে।
দেশের ৩০ লাখ মানুষ দেশকে পরাধীনতার করাল গ্রাস থেকে বের করার জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা হয়তো কল্পনাও করেননি, এমন একটা জায়গায় এসে পড়বে তাদের প্রিয় জন্মভূমি। নিজেদের ধান্দার লাইনের পরিপন্থি হলেই কাউকে দেগে দেওয়া হচ্ছে নানান অভিধায়।
ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে আসছে। এ সময়ে প্রশ্ন জাগে স্বাধীন দেশ কী তবে মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠীর জন্যই এসেছিল? তারাই সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? নিজের ইচ্ছে মতো বাঁচার, মতামত দেওয়ার, ভালোবাসার অধিকার থাকবে না? স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা জীবন চর্চা। তার সার্বিক পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টাই হোক এখনকার অঙ্গীকার।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এএসএম