ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু একসূত্রে গাঁথা

ড. হারুন রশীদ | প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রæয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।

-শামসুর রাহমান
আজ থেকে ৫১ বছর আগে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের মানুষকে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় নির্মম গণহত্যা।

তারা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পিলখানা, ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের বাসস্থানে হামলা চালায় এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বস্তি, টার্মিনালসহ জনবহুল এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। তাদের এই ভয়াবহ তাণ্ডব চলে সারারাত।

এই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। মূলত ২৬ মার্চ প্রত্যুষেই শুরু হয় বাংলার গণমানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধ। বলা চলে নিজস্ব রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তথা চূড়ান্ত লড়াই এই দিনই শুরু হয়।

তারপর হানাদারদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে একের পর এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ। এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয় শরণার্থী হিসেবে। গঠিত হয় বঙ্গবন্ধুকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সেক্টর, মুক্তিবাহিনী, গেরিলা বাহিনী, মুজিব বাহিনীসহ বিভিন্ন মুক্তি ফৌজ।

অবশেষে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন ও অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা চূড়ান্ত বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছি একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার জন্য এমন আত্মত্যাগ খুব কম জাতি করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সেদিন সমগ্র জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। সেই সময় ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ মুক্ত স্বদেশে পালিত হয় স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী। সেদিন ছিল দেশ গড়ার প্রেরণায় সবাই উজ্জীবিত। সদ্য স্বাধীন দেশটির উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি সেদিন যুদ্ধাপরাধ-মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হন।

এরপর পর্যায়ক্রমে খন্দকার মোশতাক ও সামরিক একনায়করা দেশে দুঃশাসন কায়েম করে। যারা ছিল মূলত স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিতদেরই দোসর। এদের আমলেই দেশের পবিত্র সংবিধান ক্ষত-বিক্ষত হয় ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।

স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা এখনও সক্রিয়। তারা বাংলাদেশে মূলত একটি ‘পাকিস্তানি মডেলের’ শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। তারা একসময় দেশ থেকে বঙ্গবন্ধু নাম-নিশানা মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। বেতার, টেলিভিশনসহ সব সরকারি প্রচার মাধ্যমে তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম প্রচার নিষিদ্ধ করেছিল। তারপর রাজনীতির মারপ্যাঁচে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সরাসরি অংশীদারও হয়েছিল এই স্বাধীনতাবিরোধীরা।

এতে তারা সাময়িকভাবে লাভবান হলেও আখেরে সফল হয়নি, এদেশের মানুষ তাদের সফল হতে দেয়নি। এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। এই দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে, যারা একদিন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ দিত, সেই কলঙ্কও এখন মুছে গেছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প। মহাকাশে পৌঁছে গেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বিদ্যুৎ এখন পারমাণবিক যুগে। মাতারবাড়িতে বাস্তবায়ন হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদুৎ প্রকল্প।

মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কমছে ধনী-গরিব বৈষম্য যদিও তা প্রত্যাশী অনুযায়ী নয়। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমেছে। বেড়েছে গড় আয়ু। সমর শক্তির দিক থেকেও এগিয়েছে বাংলাদেশ। নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে দুটো অত্যাধুনিক সাবমেরিন। সবদিক দিয়েই এখন শুধু সামনে এগিয়ে চলার স্বপ্ন, সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন।

স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পরে একাত্তরের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম আবার শুরু হয়ে তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী ও বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে দায় মোচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা ছাড়া আমাদের জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত করা সম্ভব নয়। তাই এই বিচার সম্পন্ন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই চেতনার মশাল জ্বালিয়ে রাখার শপথ নিতে হবে।

আমরা এই বিজয় দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহকর্মী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী সব নেতাকে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সব শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত মা-বোনদের। যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, জীবনপণ শপথ নিয়েছিল তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

আমরা এই দিবসে সেই দায়িত্বের কথা স্মরণ করছি। নতুন করে শপথ নিচ্ছি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ বঞ্চনাহীন উন্নত সমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার। দুর্নীতি রোধ, পরমত সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, গণতন্ত্র চর্চা, নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন, কার্যকর সংসদ সর্বোপরি জনপ্রত্যাশা পূরণে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।

দুই.
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বাঙালির জন্য অনন্য এক প্রাপ্তি। তিনি এমন এক নেতা যিনি বাঙালিকে দিয়েছেন একটি দেশ, পতাকা ও মানচিত্র। একটি সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কবির ভাষায় ‘পুরুষোত্তম তুমি, জাতির পিতা’।

যতই দিন যাচ্ছে বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুর অপরিহার্যতা আরও বাড়ছে। জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে আরও উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতা ছিল অকল্পনীয়। তাই বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। ইতিহাসের দেওয়াল লিখনে লেখা থাকবে-‘স্বাধীনতার অপর নাম, শেখ মুজিবুর রহমান।’

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীনতার স্থপতি। তার অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে তিনি কেবল বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবেই পরিগণিত হননি, নিজেকে তিনি নেতৃত্বের এমন এক সুমহান স্তরে সমাসীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, একাত্তরে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার নাম বলতে বলতেই দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকস্তানি হানাদারবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কারাবন্দি করে। কিন্তু কী আশ্চর্য! বন্দি মুজিব আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। রণাঙ্গনে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই হয়ে উঠলেন একেকজন মুজিব। তার নামেই পরিচালিত হলো মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অবশেষে বাঙালি পেল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতার জন্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়। কিন্তু তার নামেই পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ।

অবশেষে বাঙালি পায় তার বহুদিনের লালিত স্বপ্নের লাল সবুজ পাতাকা আর স্বাধীন মানচিত্র। অবশেষে পাকিস্তানি জান্তা স্বাধীন দেশের নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

পাকিস্তানের অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। এর মধ্য দিয়ে জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে।

১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। এদিন সশ্রদ্ধ চিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন, সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আগমন বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাঙালি যখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুযন্ত্রণা শেষে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফেরেন বঙ্গবন্ধু।

তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিনকার রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কি হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ছিল ভাষণে। তিনি প্রথমেই দেশ গড়ার ডাক দিলেন। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

সেদিন তিনি বলেন, ‘আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না, যদি এ দেশের মানুষ- যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’

১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারের রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লিতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই— বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম, ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।’- এই হলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতার অকৃত্রিমত্তা।

শোষক ও স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধুর ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে বাঙালিকে মুক্ত করে তিনি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। এ মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন।

কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সব সময় সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। শোষিত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষে শোষক, আরেক পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করে নেয় নিজেদের নেতা হিসেবে।

বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গেলে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর উক্তি সবার আগে মনে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তার সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন,‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’।

২০২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মগ্রহণের শততম বছর পূর্ণ হয়েছে। এটি অনন্য গৌরবের বিষয় যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে উদযাপন করে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো)।

মহান এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী বাঙালি জাতিকে দেয় নতুন এক দিশা। দেশাত্মবোধে নতুন করে উদ্ধুদ্ধ হয়ে পথ চলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ প্রথমবারের মতো এই দিনটি শিশু দিবস হিসেবে সরকারিভাবে পালন করা হয়। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়নি। তবে দলীয় ও বেসরকারিভাবে উদযাপিত হয়েছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতাসীন হলে এই দিনটিও আগের মতো যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হয়ে আসছে। জাতির জনকের জন্মদিনটি শিশুদিবস হিসেবে পালন করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তার বিশ্বাস ছিল আজকের শিশুই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব তাদের হাতেই। শিশুরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, মর্যাদা ও মহিমায় সমৃদ্ধ হোক- এটাই ছিল তার একান্ত চাওয়া।

বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৬ কোটিই শিশু। শিশুরা যাতে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক উপায়ে বেড়ে উঠতে পারে সেটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের আগামীর সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন শিশু দিবস হিসেবে পালনের সার্থকতা।

বঙ্গবন্ধুর জীবন শিশুদের জন্য তো বটেই সবার জন্যই এক শিক্ষণীয় বিষয়। তার অপরিসীম ত্যাগ ও তিতিক্ষার জন্য আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি যেমন আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, তেমনি দেশের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এ জন্য বাঙালি জাতি চিরকাল তাকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তাই তো কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন-

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম