রাজনীতি
বিএনপির টেকা না টেকা
গত ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে এক জনসভায় বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জামায়াত-বিএনপি এ দেশের মানুষকে কী দিয়েছে? অগ্নিসন্ত্রাস, গুম-খুন, হত্যা, লুটপাট, মানি লন্ডারিং, দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া, চোরাকারবারি -এগুলো তারা পারে'। এর আগে একাধিক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘অস্ত্র চোরাচালান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, এতিমদের অর্থ আত্মসাৎ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামির নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল টিকে থাকবে কীভাবে?’
একবার দেশের বাইরে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিস্তৃত করে বলেছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অস্ত্র চোরাচালান ও দুর্নীতির পাশাপাশি হত্যা মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত। শুধু আমাদেরই (সরকার) নয়, খালেদা জিয়ার ছেলেদের এই দু্র্নীতির চিত্র আমেরিকার এফবিআইয়ের করা তদন্তে উঠে এসেছে। আমরা বিদেশ তাদের পাচারকৃত কিছু অর্থ ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছি। তাঁদের (খালেদা জিয়া এবং তাঁর ছেলেদের) কোনো দেশপ্রেম ছিল না; তাঁদের চিন্তা ছিল ক্ষমতা ভোগ এবং লুটপাট করা।
লন্ডনে তারেক রহমানের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে হাওয়া ভবন চালুর মাধ্যমে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম এবং লুটেপুটে খাওয়া-দাওয়া শুরু করে। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বহু বার বলেছেন। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের দুর্নীতি ও বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে সুযোগ পেলেই তিনি বলতে ছাড়েন না।
কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি সম্পর্কে কড়া বা কটু কথা শেখ হাসিনা নিজের মুখে না বলে দলের অন্য নেতাদের দিয়ে বলালে ভালো হতো। কিন্তু শেখ হাসিনা নিজের কথা অন্যের মুখে তুলে দিতে পছন্দ করেন না। তিনি যা বিশ্বাস করেন, যা বলতে চান তা সরাসরি এবং অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নিজেই বলেন। তাঁর মধ্যে কোনো ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। উচিত কথা খোলাখুলি বলে তিনি একাধিকবার অনেককে চটিয়েছেন। এক সময় এমন কথাও শোনা যেত যে, শেখ হাসিনার বড় শত্রু হলো তাঁর মুখ। তিনি মুখ খুললে নাকি আওয়ামী লীগের জনসমর্থন বা জনপ্রিয়তায় ধস নামতো। মানুষ উচিত কথা শুনতে পছন্দ করে না। আর শেখ হাসিনা সহজ কথা সোজাসাপটাই বলেন।
তবে এখন অবস্থা বদলেছে। শেখ হাসিনার ওপর যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তখন তিনি সেভাবে রাজনীতি-অভিজ্ঞ ছিলেন না। বাবা-মা-ভাই, ভ্রাতৃবধূসহ আরও অনেক নিকটাত্মীয় হত্যার দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রধান কাণ্ডারি হয়েছিলেন। ফলে রাজনীতির জটিল-কুটিল পথে হাঁটতে গিয়ে তাঁকে বেগ পেতে হয়েছে অবশ্যই। তিনি ছোটখাটো ভুল করেছেন এবং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে নেমেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অনন্য সাধারণ রাজনীতিবিদ পিতার কাছ থেকে রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ যিনি নিয়েছেন, তিনি তো হার মানতে পারেন না। শেখ হাসিনা দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় হারেননি। জিতেছেন এবং ক্রমাগত এগিয়েছেন। আওয়ামী লীগকেও এগিয়ে নিয়েছেন। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর তালিকায় রাজনীতি ও নীতি শ্রেণিতে ২২ জনের মধ্যে ১১তম স্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফোর্বস লিখেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমানে তিনি চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি পাওয়ায় শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে, যার মধ্যে টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নাগরিকদের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোকে জোর দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। শেখ হাসিনার চলমান সংগ্রাম বাংলাদেশে একটি দৃঢ় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে।
আমাদের দেশে শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয় জীবিত রাজনৈতিক নেতা এখন আর কেউ নেই। অনেকে একমত না হলেও এটাই সত্য যে, একটা সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয়তার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি পাঁচটি আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জয় পেয়েছেন। শেখ হাসিনা তিনটি আসনে দাঁড়িয়ে জিতে ছিলেন একটিতে। তবে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতিতে জনপ্রিয়তার কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই। আজ যাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, সময়ের ঝাপটায় তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস নামতেই পারে। এমন উদাহরণ দেশে-বিদেশে কম নেই।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি অপরিহার্য দল। এই দল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম তার অগ্রভাগে থেকে অনন্য ইতিহাস তৈরি করেছে। এই দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রর স্থপতি তথা জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত। শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ- সব একসূত্রে গাঁথা হয়ে আছে, এগুলো যেন এক এবং অবিচ্ছেদ্য সত্তা।
তাই আওয়ামী লীগের যারা সমালোচক, যারা কোনোভাবেই এই দলের হিতাকাঙ্ক্ষী নন, তাঁরাও যাই ভাবুন বা বলুন না কেন, আওয়ামী লীগ আছে এবং থাকবে। এই দলটির পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হওয়ার আশঙ্কা অমূলক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের ট্র্যাজেডির পর কেউ কেউ ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ শেষ।
ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা এই দলের আর নেই। সেটা সত্য হয়নি। আওয়ামী লীগ যেহেতু ইতিহাসের স্রষ্টা, তাই ইতিহাস থেকে এই দলের নাম মুছে ফেলা সহজ নয়। আওয়ামী লীগ যদি সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়, যদি জনপ্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দলের নীতি-কর্মসূচি-কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে পারে তবে এই দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি নামের দলটি কি টিকে থাকবে না? আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিএনপির জন্ম সেভাবে নয়। বিএনপি জন্ম ক্ষমতার গর্ভে এবং বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী ও কোটারির স্বার্থ আদায় কিংবা রক্ষার উদ্দেশে। সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী একজন জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সংহত করতে গড়ে তুলেছিলেন এই দলটি।
সমস্বার্থের এবং এক নীতি-দর্শনে বিশ্বাসী মানুষেরা সাধারণত একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা তলে সমবেত হন। কিন্তু বিএনপি গঠিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন মত-পথের সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী, দলছুট, ক্ষমতালোভী কিছু মানুষের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হয়ে। বিপরীত রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী মানুষের এমন জমায়েত সাধারণত তেমন স্থায়ী হয় না। সেজন্য জিয়ার দুঃখজনক মৃত্যুর পর বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সে শঙ্কাও অমূলক বলে প্রমাণ হয়েছে।
এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নতুন করে বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে? এটা ঠিক যে, কয়েকবার দেশের শাসক দলের গৌরবচিহ্ন বুকে নিয়েও বিএনপি কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে ভালো অবস্থায় নেই। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আছে ১৫-১৬ বছর হয়ে গেলো। কিছু ভুল রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল বিএনপিকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখান থেকে বিএনপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না সে সংশয় রাজনৈতিক মহলে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘বিএনপি টিকবে কীভাবে?’ সে প্রশ্ন আরও অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে তাই বলে এক কথায় এটা বলে দেওয়া যাবে না যে, বিএনপি টিকবে না।
কেন বলা যাবে না যে, বিএনপির কোনো ভবিষ্যৎ নেই? একাধিক কারণের একটি হলো, আমাদের দেশ প্রধানত দুটি রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত। এক ধারার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, অন্য ধারার বিএনপি। বিএনপি যে রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করে সেই ধারায় বিশ্বাসী মানুষের দেশে আগেও ছিলেন, এখনো আছেন এবং তাদের সংখ্যা বরং বাড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতন্ত্র, বাঙালি সংস্কৃতি ইত্যাদির পক্ষেই মূলত আওয়ামী লীগের অবস্থান। এর বিপরীত সব কিছুর পক্ষে বিএনপি।
এই দুই দলের বাইরে ডান-বাম ধারার আরও কিছু দল দেশে থাকলেও তারা মূলত মোটা দাগে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সঙ্গেই জোটবদ্ধ। জোটের বাইরে থাকলেও তাদের বক্তব্য হয় আওয়ামী লীগ, নয় বিএনপিকে পুষ্টি জোগায়। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান না থাকলেও বিএনপি থাকবে আওয়ামী লীগের বিরোধী ধারার রাজনীতির অস্তিত্বের কারণেই।
দেশের মানুষের মধ্যে যে আদর্শিক বিভাজন তা দূর করার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো উদ্যোগ-প্রচেষ্টা নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও বিরোধী মতের মানুষের সমর্থন আদায়ের কোনো চেষ্টা নেই। আগে আওয়ামী লীগের নিয়মিত কিছু সাংগঠনিক কার্যক্রম থাকতো। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আলোচনা, প্রশিক্ষণ, রাজনৈতিক বইপত্র পড়া– এসব এখন আর হয় না। অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে, আওয়ামী লীগ শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয় বিরোধী দলে থাকলে, দুর্বল এবং জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় ক্ষমতায় থাকলে।
আওয়ামী লীগের থাকলে যে বিএনপির থাকাটাও প্রায় নিশ্চিত তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকেও বোঝা যাচ্ছে। এত বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও বিএনপি কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘাম ঝরানোর ক্ষমতা হারায়নি। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির জমায়েত করতে পারাটা দুর্বলতার পরিচয় বহন করছে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম