জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে যখন কোনো স্থানের মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে স্থায়ীভাবে বা অস্থায়ীভাবে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হয়, তখন তাদের ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ বলা হয়।
বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন বিভিন্ন কারণে চরম জলবায়ু সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের মানুষ প্রধানত এর শিকার হলেও উন্নত দেশগুলোতেও তা ঘটছে।
স্থানীয় পরিবেশে আকস্মিক বা দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের কারণে মানুষ তাদের নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মানুষের জীবন-জীবিকা ব্যাহত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বলতে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বন উজাড়, দাবানল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকার বাড়িঘর ও ভূমি তলিয়ে যাওয়া, পানি কমে যাওয়া ইত্যাদিকে বোঝায়।
আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন, বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং সেচের জলের অভাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। মানুষ যে হারে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঝড়, দাবানল ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ছে, তা এতটা ভয়ংকর আর কখনো ছিল না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে অনেক দেশের উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে গেছে এবং জমিও চাষের উপযোগিতা হারিয়েছে। ফলে সেখানকার মানুষ অন্যত্র— দেশের ভেতরে বা বাইরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইডিএমসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ, বিশ্বব্যাপী ৫৯.১ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, সংঘাত, বাণিজ্য এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। সাম্প্রতিককালে আটজনে একজন, ১ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ২৮১ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং কয়েক মিলিয়ন মানুষ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
গত তিন দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আরেকটি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, বিশ্বব্যাপী ১৬০ মিলিয়ন থেকে ২৬০ মিলিয়ন মানুষ এর শিকার, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দরিদ্র মানুষ। বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৭ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে এবং সেখানে বসবাসকারী দুই কোটি মানুষকে সরে যেতে হবে।
বাংলাদেশের বিষয়ে আইডিএমসি বলেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা ১৩.৩ মিলিয়নে পৌঁছাতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরের বস্তিতে, বিশেষ করে ঢাকার বস্তিতে বসতি স্থাপন করছে। ফলস্বরূপ, ঢাকা দিন দিন একটি দ্রুত বর্ধনশীল এবং বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর হয়ে উঠছে। ঢাকাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে কারণে সারাদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ ঢাকায় ছুটছে- যাদের শেষ আশ্রয় হচ্ছে বস্তিতে।
কাজেই ঢাকায় বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ দেখা যাচ্ছে যাদের সমস্যার শেষ নেই। খাদ্য ও জীবনযাত্রার সমস্যা, পানির সমস্যা, স্বাস্থ্য সমস্যা, কাজ পেতে সমস্যা এবং আরও অনেক সমস্যা নিয়ে এসব দরিদ্র মানুষ ঢাকার রাস্তায় ছুটে চলেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর প্রায় চার লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বা উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসে। তাদের অধিকাংশই জলবায়ু উদ্বাস্তু। ফলে ঢাকা শহর জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বস্তিতে পরিণত হয়েছে বলে অনেক পরিবেশবিদ মনে করেন।
এই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ঢাকামুখী হওয়া বন্ধ করা না গেলে আগামী কয়েক দশকে ঢাকার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঢাকা ইতোমধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহরে পরিণত হয়েছে।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘গ্লোবাল লিভাবিলিটি র্যাঙ্কিং রিপোর্ট-২০২১’ অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। এ থেকে ঢাকার বাসযোগ্যতার চিত্র সহজেই অনুমেয়। অভ্যন্তরীণ জলবায়ু শরণার্থীদের ঢাকা অভিমুখে যাওয়া বন্ধ না করলে ঢাকার বাসযোগ্যতা সূচক আরও নিচে নামবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করেছি। সুতরাং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে মানুষ যাতে ঢাকামুখী না হয় সেজন্য স্থানীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সঠিক কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এটি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করতে হবে। বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দ্রুত ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল প্রদান করতে হবে। এ তহবিলের একটি অংশ জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে ব্যয় করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মানবাধিকার আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আইনি স্বীকৃতি, সুরক্ষা এবং সহায়তা প্রদানের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা দরকার। সদস্য দেশগুলোকে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা উচিত এবং প্রতিটি দেশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিটি দেশের সরকারকে সক্রিয় হতে হবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম