বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং কানেক্টিভিটি
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে কানেক্টিভিটি। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সড়ক ও রেলপথ দেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোকে এক অভিন্ন নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে এসেছে। এমনকি নৌপথেও এখন দুই দেশের কানেক্টিভিটি জোরালো হয়ে উঠছে। এর সুবাদে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব কমার পাশাপাশি এসব এলাকার বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও অনেক জোরদার হয়ে উঠেছে।
ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম থেকে নৌপথে পণ্য আমদানি-রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠছে কুড়িগ্রামের চিলমারী নৌবন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ভারতের ত্রিপুরা-আসাম-মেঘালয়ের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোসহ দেশটির গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্যই সম্ভাবনার বড় দুয়ার খুলে দিয়েছে।
এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেতে দীর্ঘদিন ধরেই আগ্রহ দেখিয়ে এসেছে ভারত। আবার বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের সুবাদে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয় বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকেও দমন করতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, সাম্প্রতিক তার বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, আঞ্চলিক সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি বড় নির্ধারক হিসেবে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর স্বার্থকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে বড় মাত্রায় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই সরাসরি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত পর্যায়ে ইস্যুভিত্তিক আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে সামনের দিনগুলোয় দেশটির কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা অঞ্চলকেন্দ্রিক সমাধানের দিকে এগোনোর জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশীরাও এটাকে ইতিবাচক দৃস্টিতে দেখছেন।
ভারতীয় থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ওআরএফ ফাউন্ডেশনের এক সম্প্রতি প্রকাশিত পলিসি পেপারে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক নিম্মি কুরিয়ান লেখেন, প্রান্তিক পর্যায়ে গৃহীত বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির কারণে সীমান্ত এলাকায় নতুন একদল স্টেকহোল্ডারের (স্বার্থসংশ্লিষ্ট) উত্থান ঘটেছে, যারা উপ-আঞ্চলিক সংযুক্তি থেকে বড় মাত্রায় লাভবান হতে পারেন।
বিশেষ করে এখন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্তে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেনদরবারের সামর্থ্য বেড়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি।
এ চুক্তির পেছনে মূল অনুঘটক ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকায় নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্য পরিচালনার সম্ভাবনা নিয়ে আসামের আগ্রহ। এর মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভারতের কেন্দ্র, রাজ্য এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর মধ্যে এখন সমন্বয়ের একটি বড় জায়গা হয়ে উঠেছে সীমান্ত। বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারণী সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলে আসামের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ বিষয়ই পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
অনেক ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্র সরকারও দেশটির বিভিন্ন রাজ্যকে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক বা কানেক্টিভিটি সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চালানোর ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা করছে। প্রধানত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোই এখন এ সীমান্তকেন্দ্রিক কূটনৈতিক সম্পর্কের বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছে। অঞ্চলটিকে দেখা হয় ভারতের সমৃদ্ধতম কিন্তু সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে। অনুন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ভারতের বাকি অংশ থেকে ভৌগোলিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্নতাকে অঞ্চলটির দীর্ঘদিন পিছিয়ে থাকার প্রধানতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য এলাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন’স নেক নামে অভিহিত সংকীর্ণ একটি করিডোর। সমুদ্র সংযোগবিচ্ছিন্ন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য সবচেয়ে কাছের বন্দর ছিল কলকাতা। সেখান থেকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহন করতে দীর্ঘ পথ ঘুরে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত কানেক্টিভিটি এখন এ পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছে ভারত। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত কানেক্টিভিটিকে দেখা হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্যের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের বড় চাবিকাঠি হিসেবে। এ কানেক্টিভিটিকে কেন্দ্র করে রাজ্যগুলোয় এখন ব্যাপক মাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
কিছুদিন আগেই ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেতুটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ সেতু দুই দেশের সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করেছে বলে সম্প্রতি এক নাগরিক সংবর্ধনায় উল্লেখ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। ত্রিপুরার বর্তমান ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রীরাও নানা সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন।
তবে, সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর স্বার্থ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যতম অনুঘটক হলেও প্রধানতম নয় । ভারতের বৈদেশিক নীতিতে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো কিছু প্রভাব রাখলেও তাকে মুখ্য ধরা যাবে না। যেমন নদীর পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। একইভাবে চোরাচালান প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও সীমান্তকেন্দ্রিক নানা বিষয়ের প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। তবে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির চিন্তাভাবনাকে পুরোপুরি সীমান্তকেন্দ্রিক বলা যাবে না। আবার আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেখা যাবে এখান থেকে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সবাই সমানভাবে লাভবান নাও হতে পারে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়কে রেলপথে সংযুক্ত করার জন্য একটি প্রকল্প এখনো পরিকল্পনাধীন রয়েছে। এজন্য পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট থেকে হিলি হয়ে বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ-তুরা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে, যা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাকে মেঘালয়ের গারো হিলস এলাকার সঙ্গে যুক্ত করবে। এ বিষয়ে আলোচনা শুরুর জন্য মেঘালয়ের কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রের সম্মতি পেয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে।
চলতি বছরের জুলাইয়ে আসামে আয়োজন করা হয় দ্বিতীয় নর্থইস্ট বায়ার সেলার মিট ২০২২। গত বছর শুরু হওয়া এ সম্মেলনের দুটি আয়োজনেই যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা। এ সম্মেলন আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে তুলে ধরা। আসাম সরকারকে এ সম্মেলন আয়োজনের ক্ষেত্রে মূল সহযোগিতা দিয়ে এসেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স।
এছাড়া সীমান্ত এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় পর্যায়ের আলোচনা চালু রয়েছে দুই দেশেই। বিভিন্ন সময়েই দুই দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার এবং অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধে আলোচনায় বসেছেন।
ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে আরো বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আরো বেশি আগ্রহ ও উদ্যোগের প্রয়োজন । সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো হলে, নিয়মিত নিজেদের সার্বিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনা হলে সীমান্ত হত্যা, মাদক-অস্ত্রের পাচার, মানব পাচারসহ নানা সমস্যার সমাধান হতে পারে। বাণিজ্য স্বার্থ উভয়ের জন্যই লাভবান হবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম