রাজনীতি
বিজয়ের আনন্দ বনাম ১০ ডিসেম্বরের আতঙ্ক
ফারাবী বিন জহির
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। এই ডিসেম্বরে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। এই ডিসেম্বর মাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের বিজয় গাথা। এই ডিসেম্বর আমাদের অর্জনের মাস, আমাদের বিজয় উদযাপনের মাস। যে ডিসেম্বর মাসে আমাদের গৌরবগাথা উদযাপনের কথা ছিল সেই ডিসেম্বরে জাতি উৎকণ্ঠিত। যে ডিসেম্বরে বিজয় উদযাপনের কথা ছিল, সেই ডিসেম্বর মাসে জাতি আড়ষ্ট। এই লজ্জা কার? আমরা কি কোনোদিন ভেবে দেখেছি?
সম্প্রতি বিরোধী দলের এক নেতার ১০ ডিসেম্বরকেন্দ্রিক একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উৎকণ্ঠার জন্ম নিয়েছে। সেই নেতা তার বক্তব্যে দাবি করেছেন, ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশের মূল চালিকাশক্তিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে।
স্বভাবতই তার এই দাবির পর সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, যে দেশে একটি সরকার বিদ্যমান এবং ১০ ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, তাহলে কীভাবে এই মূল চালিকাশক্তির পরিবর্তন সম্ভব? তাহলে কি কোনো অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি বেছে নেয়া হচ্ছে? দেশের সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তাকে জিম্মি করে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
দেশবাসীর এমন উৎকণ্ঠার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। আন্দোলনের নামে দেশে ভাঙচুর, নৈরাজ্য, ত্রাস সৃষ্টির অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। দেশবাসী দেখেছে আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে দেশের সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।
আগুন সন্ত্রাস কিংবা আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার স্মৃতি মানুষের মনে এখনো জ্বল জ্বল করে। দেশের মানুষ দেখেছে কীভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে রাজনীতির মারপ্যাঁচে কীভাবে তাজা প্রাণ ঝরে যায়। তাই রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা মনে হলেই দেশবাসীর চোখে ভেসে ওঠে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির ছবি।
এই অবস্থা কেন হলো? এ অবস্থার জন্য দায়ী কে? সহজ কথায় উত্তর দিতে গেলে বলতে হয় এ অবস্থার হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং বিরোধী মত দমনের চেষ্টা। হোক বিরোধী দল কিংবা সরকারি দল উভয়কেই তাদের বিপরীত মতাবলম্বীদের ব্যাপারে যে সহনশীল ভূমিকা পালন করার কথা ছিল তা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো।
সহনশীলতা প্রদর্শন তো দূরের কথা, বোমা মেরে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার ভয়াবহ উদাহরণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। সংসদ হওয়ার কথা ছিল সব রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। অথচ সেই সংসদকে উপেক্ষা করে রাজপথকে করা হয়েছে সব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হামলা এবং মামলা অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
যে রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল মানুষের কল্যাণে, সেই রাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কিংবা ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে। রাজনীতির নামে কিছু রাজনীতিবিদের অহেতুক ও বিব্রতকর কাজ মানুষকে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিছু রাজনীতিবিদ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেও আলিঙ্গন করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এসব কারণে রাজনৈতিক আন্দোলন নাম শুনলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সম্প্রতি এই আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে ১০ ডিসেম্বরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বক্তব্য।
এই ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে দুপক্ষের মধ্যে বিবৃতি এবং পাল্টা বিবৃতি। দুপক্ষের শিবিরেই সাজ সাজ রব অবস্থা। দুই পক্ষই দিচ্ছে শক্তির মহড়া। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে রাজনীতি যে জনগণের কল্যাণে করার কথা ছিল সেই জনগণের ভোগান্তির কথা কেউ চিন্তা করছে না। কেউ ভাবছে না তাদের এই শক্তির মহড়ায় আসলে জনগণ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে। জনগণের এই রাজনৈতিক আন্দোলনের থেকে আসলে অর্জনের কি আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর যারা আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি করছে তাদের আদৌ জানা আছে?
‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’ বলেই আজকে আমাদের সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক আন্দোলনের নাম শুনলেই ভয় পায়। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে তাদের রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। ১০ ডিসেম্বরকেন্দ্রিক মন্তব্য তার ব্যতিক্রম নয়। যে বা যারা ১০ তারিখে পটভূমি পরিবর্তনের কথা বলছেন, তারা কি জনগণের কাছে পরিষ্কার করেছেন তারা কোন পন্থায় পরিবর্তন চান? জনগণ চাইলে সংবিধানসিদ্ধ উপায়ে দেশে পটপরিবর্তন হতেই পারে। কিন্তু যারা পটপরিবর্তন চাইছেন তারা কি সংবিধানসিদ্ধ উপায়ে চাইছেন? যদি তা না হয় তাহলে অগণতান্ত্রিক কোনো উপায়ে পরিবর্তন কীভাবে জনগণের কল্যাণে লাগতে পারে? এই বিষয়গুলো তারা এখনো জনগণের কাছে পরিষ্কার করেনি।
এমন এক সময় এই অস্থিরতা সৃষ্টি হলো যখন বিশ্ব অর্থনীতি এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একে তো করোনার ধাক্কা, তার ওপরে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে। বাংলাদেশকেও এই ঝুঁকি মোকাবিলা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এবং শস্য এবং খাদ্যসহ আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ন্ত, ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা এবং রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাওয়াসহ সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
অর্থনীতির এমন সংকটময় মুহূর্তে এই ধরনের সহিংস আন্দোলনের ডামাডোল জনগণকে কীভাবে উপকার করতে পারে? বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস যখন সারাবিশ্বকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। ঠিক তখন আমাদের কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত ক্ষমতার লড়াইয়ে। দিনের শেষে তাদের এ ক্ষমতার লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশের জনগণের জীবনকে অর্থনৈতিকভাবে আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে এই আন্দোলনের ডামাডোল।
সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ১০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশের জায়গা নিয়ে টানাহেঁচড়া। দুপক্ষই তাদের পছন্দের জায়গায় কীভাবে সমাবেশ করা যায় সেই কলাকৌশল বানাতে ব্যস্ত। দু’দলই তাদের মনবাসনা পূরণে অধিক মনোযোগী। কোন জায়গায় সমাবেশ করলে জনদুর্ভোগ কম হবে কিংবা জনগণের ভোগান্তি কম হবে তা নিয়ে ভাবার সময় বা ইচ্ছা তাদের নেই। তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি হাসিলে অধিক ব্যস্ত। জনগণকে নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, মানুষের জন্যই রাজনীতি। মানুষের কল্যাণেই রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেই রাজনীতি যখন দেশের মানুষের কল্যাণে আবর্তিত না হয়ে দেশের মানুষের স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় তখন সেই রাজনীতি হয়ে যায় অপরাজনীতি। এই ধরনের অপরাজনীতির কারণেই অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার সাহস পায়। তাই নিজেদের স্বার্থে দেশের মানুষের উচিত এই ধরনের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
লেখক: কলামিস্ট ও অ্যাকটিভিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস