হাল জমানার রাজনীতি
ক’দিন আগে ব্যক্তিগত কাজে আমার একটি বিভাগীয় শহরে যাওয়া পড়েছিল। সে সময় ওই শহরের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এ সময়ের বহুল আলোচিত সমাবেশগুলোর অন্তত একটিকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগটা আমি একদমই হাতছাড়া করতে চাইনি।
মহাসমাবেশের আগের রাতে মহাসমাবেশস্থল আর শহরে ঘোরাঘুরি আর সমাবেশের দিন সকাল থেকে সমাবেশটির শেষ পর্যন্ত চারপাশে হাল-হকিকত দেখে এদেশের হালের রাজনীতি নিয়ে আমার কিছু নতুন উপলব্ধি পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার তাগিদটা বেশ ক’দিন ধরেই খুব বেশি করে তাড়া দিচ্ছিল বলেই এই দফায় লিখতে বসা।
মহাসমাবেশের আগের দিন বিমানে বিভাগীয় শহরটিতে পৌঁছালাম। সড়কপথে যাওয়ার উপায় নেই, কারণ পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে বিভাগীয় শহরটিকে কার্যত দেশের অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। কিন্তু এতে করে জনসমাবেশের কোনো ঘাটতি হতে আমি দেখিনি। বরং রাতের বেলা সমাবেশের ময়দানে ঘুরতে গিয়ে মনে হয়েছে সেখানে একটা উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করছে।
বিশাল মাঠে মানুষে থৈ থৈ অবস্থা। যে বিভাগীয় শহরটিতে সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সেখানকার মানুষ যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, সম্মেলনস্থলে বেশিরভাগ না হলেও অনেক মানুষকেই তার চেয়ে ভিন্ন ডায়ালেক্টে কথা বলতে শুনলাম। আমার চেম্বারে যেহেতু সারাদেশের মানুষের যাতায়াত, প্রায় দুই দশকের চেম্বার প্র্যাক্টিসের অভিজ্ঞতার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আঞ্চলিক কথোপকথনের সাথে আমি বেশ ভালোভাবেই পরিচিত।
সে অভিজ্ঞতায় বেশ বুঝতে পারছিলাম এই মানুষগুলোর অনেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন। এসেছেন সুদূর উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গ থেকেও। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সমাবেশে অংশ নিতে তারা আগে-ভাগেই চলে এসেছেন।
সমাবেশস্থলের আশপাশে শীতের রাতে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের শীতের খাবার আর ডিনার তো বটেই। মাঠের চারপাশে পুলিশের সতর্ক উপস্থিতি নিশ্চিত করছে সমাবেশে যারা এসেছেন তাদের নিরাপত্তা। এমনকি সিটি করপোরেশন থেকে ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের সুবন্দোবস্ত দেখলাম।
এক কথায় যাকে বলে শীতের রাতে উৎসবের আমেজ। ক’দিন আগে একজন মন্ত্রীকে বলতে শুনেছিলাম বিরোধীদের এই সমাবেশগুলো পিকনিকে পরিণত হয়েছে। এবার নিজের চোখে দেখে বুঝলাম মন্ত্রীমহোদয় খুব একটা ভুল বলেননি।
তবে দলীয়দের চেয়েও যারা বেশি দলবাজ, যাদের আওয়ামী প্রেম আওয়ামী লীগারদের চেয়েও দুই কাঠি সরেস, সেই লোকগুলোর কথা ভাবতে বেশ বিরক্তই লাগছিল। খোদ সরকারপ্রধান যেখানে সুস্থ রাজনীতির চর্চা আর গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে বিরোধী দলের সমাবেশগুলোকে উৎসাহিত করছেন, সেখানে একদল অতি উৎসাহী মানুষ পরিবহন ধর্মঘট ডেকে বরং সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে বলেই আমার সেদিন রাতে ওই সমাবেশস্থলে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে।
পাশাপাশি ধন্যবাদ না জানিয়ে পারিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। বাংলাদেশের কোন বিরোধী দল কোন জমানায় এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রাজনৈতিক সমাবেশ করতে পেরেছে বলে আমার মনে পড়ে না। ভালো লাগছিল বিরোধী দলের সহনশীল আচরণেও। বেশ ফুরফুরে আমেজে সারাদেশ থেকে আসা বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা পিকনিকের আমেজে রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। কোথাও কোনো উত্তেজনা বা অস্থিরতা দেখলাম না।
ভুলটা অবশ্য ভাঙলো পরদিন। সকালে ঘুম ভাঙতেই ধারণাটা পাল্টে গেলো। যে হোটেলে উঠেছিলাম তা শহরের বড় রাস্তার ধারে। ঘুম ভাঙল সমাবেশমুখী মিছিলের স্লোগানে। স্লোগান না বলে বরং বলা ভালো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অশ্রাব্য খিস্তি-খেউরিতে।
তারা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে কখনো আগুন জ্বালাচ্ছেন তো কখনো সরকারকে টেনে- হিঁচড়ে গদি থেকে নামাচ্ছেন। আর সাথে আরও কত কি যে করছেন সে প্রসঙ্গ না হয় এখানে নাই টেনে আনলাম। বুঝলাম সরকার প্রধান যে রাজনৈতিক উদারতা দেখাচ্ছেন সেই উদারতাকে গ্রহণ করার মানসিকতায় এদেশের বিরোধীরা এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
তবে আমার বোঝার বাকি ছিল আরও অনেকখানি। রাতে যে সমাবেশস্থল জনারণ্যে পরিণত হয়েছিল, দুপুরে সমাবেশ শুরু হতে বোঝার জোটিও নেই যে, এখানে ১২ ঘণ্টার আগেই এত মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। পড়ন্ত বিকেলের জনসভায় মাঠ অর্ধেক খালি। রাত জেগে যারা গান শুনেছেন, আড্ডায়-জলসায় পিকনিকের আমেজে শীতের রাতটাকে উপভোগ করেছেন, তারা বেশিরভাগই উধাও।
হয়তো বাসায় গিয়ে যে যার মত ঘুমাচ্ছেন কিংবা ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করেছেন যে যার পথে উত্তর কিংবা দক্ষিণবঙ্গের পথে। এসব জনসভায় সরকারের পতন যে কতদূর কি হবে তা তাদের বোঝা সাড়া। পিকনিক শেষে সবাই এখন তাই ঘরমুখী। বুঝলাম এদেশের রাজনীতি বুঝতে আমার ঢের বাকি আছে।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস/ফারুক